ইভটিজিং: ইতিবাচক পৃথিবীর নেতিবাচক কর্ম

সিনেমাহলের একটি বিশেষ ক্ষমতা আছে। অনেকগুলো মানুষকে পেটের মধ্যে নিয়ে অন্ধকার একটি ঘরে ত্রিশ ফুট চওড়া সাদা পর্দায় যখন ছবি চালতে শুরু করে, তখন পেটের ভেতরে থাকা দর্শকরা এক অন্য জগতে স্থানান্তরিত হয়। সেই জগতে সরব থাকে শুধু পর্দার লোকজন, ঘটনা ঘটে শুধু তাদের জীবনে, এপাশে বসে থাকা মানুষগুলো নীরবে সেই ঘটনার সাক্ষী হয়, তাদের আনন্দে হাসে, দুঃখে কাঁদে। সিনেমাহলের এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করার জন্য গল্প তৈরী করে ছবি নির্মান করে সাদা পর্দায় প্রক্ষেপন করতে পারাটাই পরিচালকের যোগ্যতা, সিনেমার স্বার্থকতা। ছবি বিচারের এই যদি হয় মাপকাঠি, তবে কাজী হায়াৎ পরিচালিত সিনেমা ‘ইভটিজিং‘ একটি সার্থক চলচ্চিত্র। কিন্তু সিনেমাহলের বাহিরের চিন্তাভাবনা-বিশ্লেষণ যদি মাপকাঠির অন্তর্ভূক্ত হয়, তবে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজনও বাড়ে।

ইভটিজিং চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র কাশেম। তার পেশা রিকশা ভ্যানে করে অপঘাতে মৃত লাশ নিয়ে লাশকাটা ঘরে পৌছে দেয়া এবং কাটা লাশ আবার ফেরত নিয়ে আসা। কাশেম পিতৃহীন ও দরিদ্র, পরিবারে তার মা এবং ক্লাস নাইনে পড়ুয়া আদরের ছোট বোন হোসনে আরা। কাশেমের স্বপ্ন ছোটবোনকে ‘ম্যাট্রিক’ পাশ করাবে কিন্তু ইভটিজিং নামক সামাজিক ব্যাধির শিকারে পরিনত হওয়া হোসনে আরার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার জীবন যে পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় সে গল্প নিয়েই ইভটিজিং চলচ্চিত্র।

ছবির নাম ইভটিজিং হলেও ইভটিজিং ছবির একাধিক উপকরণের একটি। চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ গল্পই আবর্তিত হয়েছে প্রধান চরিত্র কাশেমকে কেন্দ্র করে। কাশেম সৎ, সরল, পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল, স্নেহপ্রবণ, অনুগত, বন্ধুবৎসল – এই সকল গুণ তুলে ধরার ক্ষেত্রে ইভটিজিং এর ঘটনা অন্যতম সহায়ক উপকরণ। সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে চলচ্চিত্রের নাম যদি ইভটিজিং না হয়ে ‘কাশেম’ অথবা ‘মরা টানা কাশেম’ হয় – তবে নামকরণ তুলনামূলকভাবে বেশী স্বার্থক হয়। কাশেমের চরিত্র অতি সরলতার দোষেও দুষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে, হোসনে আরা যখন নির্যাতনের শিকার হয় তখন কাশেমের আচরণ একে নির্বুদ্ধিতা হিসেবে উপস্থাপন করে।

ইভটিজিং ছবির প্রেক্ষাপট গ্রাম এবং সময় বর্তমান। কাহিনীকার কাজী হায়াৎ অত্যন্ত চমৎকার বুননে যৌক্তিকভাবে নানা ঘটনাবলীর সাথে তুলে ধরেছেন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা এবং তলোয়ার খেলা। এই দুই খেলার সাথে যাদের ধারনা নেই তারা লাঠি ও তলোয়ার যুদ্ধ বলে ধারনা করতে পারে, কিন্তু এর পোশাক, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে ধারনা করা সম্ভব না। বিলুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্যবাহী খেলাকে বেশ দারুণভাবে তুলে ধরার জন্য কাহিনীকারকে ধন্যবাদ।

কাজী হায়াৎ এর দৃষ্টিতে পৃথিবী ভালোয় পরিপূর্ণ, প্রায় সবকিছুই ইতিবাচক কিন্তু অল্প কিছু মানুষ এবং তাদের কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে কলুষিত করে তুলছে। এই দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায় এমন কিছু ছবির তালিকায় আম্মাজান, ইতিহাস, ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না ইত্যাদির পাশাপাশি ইভটিজিং-ও যুক্ত হবে।

ইভটিজিং এর ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। তবে, তার আগে কাজী হায়াৎ এর দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে ধারনা থাকা প্রয়োজন। কাজী হায়াৎ এর দৃষ্টিতে পৃথিবী ভালোয় পরিপূর্ণ, প্রায় সবকিছুই ইতিবাচক কিন্তু অল্প কিছু মানুষ এবং তাদের কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে কলুষিত করে তুলছে। এই দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায় এমন কিছু ছবির তালিকায় আম্মাজান, ইতিহাস, ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না ইত্যাদির পাশাপাশি ইভটিজিং-ও যুক্ত হবে। বরং, অন্যান্যগুলোর তুলনায় ইভটিজিং এ এই দৃষ্টিভঙ্গীর ছাপ তুলনামূলকভাবে বেশী স্পষ্ট। পরিচালকের এই দৃষ্টিভঙ্গী যদি দর্শকের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়, তবে ‘ইভটিজিং’ ও গ্রহণযোগ্য হবে, অন্যথায় নয়। কাজী হায়াতের ছবিতে ভালো কথা আর পরামর্শ থাকবেই – তার ছবিকে শিক্ষামূলক ছবি বলবেন না নাকি বিনোদনমূলক – সে বিচার দর্শকের।

ছবিতে মোট গান আটটি। একটি আধ্যাত্মিক বাউল গান, একটি লাঠি খেলার গান। বাকী পাঁচটির একটি হিন্দী, চারটি ফোক। প্রত্যেকটা গানই এত চমৎকার হয়েছে যে শুধু গান শোনার জন্য আরেকবার সিনেমাহলে যাওয়া যায়। সুর এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন সাগীর আহমেদ – তাকে ধন্যবাদ।

কাশেম চরিত্রে কাজী মারুফ অভিনয় করেছেন। হাতে গোনা কয়েকটা দৃশ্য বাদে তিনি ভালো অভিনয় করেছেন। নাচের দৃশ্যে তাকে আগেও ভালো লাগে নি, এবারও লাগল না – বেশ জড়তাপূর্ণ নৃত্য। কাশেমের প্রতি অনুরক্ত চাচাতো বোন কুলসুমের চরিত্রে তমা মির্জা আকর্ষণীয় এবং চমৎকার অভিনয় করেছেন। এ দুয়ের দৃশ্যগুলো উপভোগ্য। পরিচালক, কাহিনীকার কাজী হায়াৎ অভিনেতা হিসেবে মোটেও চমৎকার নন – আরও একবার এই অনুভূতি হল। মনি ডাক্তার চরিত্রে তাকে শিক্ষক বলে মনে হচ্ছিল। আরও একটু প্রাণবন্ত অভিনয় খুব প্রয়োজন ছিল এই চরিত্রে। কানাই ডোম চরিত্রে কাবিলা যথারীতি ভালো অভিনয় করেছেন।

আলাদা আলাদা ভাবে ছবিতে দুর্বলতা অনেক। পরিচালক রাত-দিনের পার্থক্যকে দর্শকের চোখকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কন্টিনিউটি ব্রেক আছে বেশ কিছু। লাঠি খেলা, তলোয়ার খেলার জন্য হাজার লোককে একত্রিত করেছেন, কিন্তু খেলাকে আরও জমিয়ে তুলতে সক্ষম হন নি। সম্পাদনায় জোড়াতালি দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। বাণিজ্যিক কারণে নায়িকার শরীরে অহেতুক ক্যামেরা ঘুরে বেড়িয়েছে। কাজী মারুফের কস্টিউম আকর্ষণীয়, কিন্তু বর্তমান সময়ের বিচারে এই কস্টিউম বাতিল। শেষ দৃশ্যে তমা মির্জার রূপসজ্জাবিহীন মুখ অনেক বেশী পছন্দনীয়।

সামগ্রিক বিচারের মাপকাঠিতে ইভটিজিং সম্পূর্ণ সফল নয়, তবে এফডিসি নির্ভর ছবির তুলনায় ইভটিজিং বেশ ভালো একটি ছবি। ত্রুটি বিচ্যুতি ছাড়িয়ে ছবি যদি দর্শককে তৃপ্ত করতে পারে তবেই পয়সা উসুল – ইভটিজিং দর্শককে তৃপ্তি দিয়েছে।

ছবি মুক্তির আগে থেকেই শোনা যাচ্ছে ইভটিজিং কাজী হায়াৎ এর শেষ ছবি। প্রায় চল্লিশটি চলচ্চিত্রের নির্মাতা এখানেই দাড়ি টানলে দর্শক বঞ্চিত থেকে যাবে। শেষ ছবি হিসেবে ইভটিজিং একটি ভালো সমাপ্তি। ভালো থাকুন কাজী হায়াৎ।

রেটিং: ৪/৫

ছবি কৃতজ্ঞতা: বাংলা মুভি ডেটাবেজ

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

3 Comments on “ইভটিজিং: ইতিবাচক পৃথিবীর নেতিবাচক কর্ম”

  1. আমার কাছে ভাল লেগেছে। আপনার বিশ্লেষণ সুন্দর। তবে বেশ কিছু সংলাপ ছিলে ছবিতে যা কিনা মনে দাগ কাটার মত। ঐগুলা নিয়ে লেখলে আরও ভাল লাগত ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *