শত শত ঘুড্ডি চাই

ঘুড্ডি সিনেমার দৃশ্য

ঘুড্ডি। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের আকাশে এখন দুর্যোগের ঘনঘটা চলছে। রোমান্টিক ছবির বাড়িতে এখন দৈন্যতা, দেউলিয়াপনা এখন ছবির গল্পে, নামে, গানে এবং অভিনয়ে। আমাদের চলচ্চিত্রে এখন দক্ষিণ ভারতীয় ভালোবাসা চিত্রিত হয়, সে চুরি করা কাহিনীর মাধ্যমে কিংবা যৌথ প্রযোজনায় পশ্চিমবঙ্গের নির্মাতাদের সাথে যুথবদ্ধ হয়ে। সেন্সরবোর্ডের তাড়া খেয়ে ‘রোমিও ভার্সেস জুলিয়েট’ থেকে ‘রোমিও বনাম জুলিয়েট‘ হয়ে যাওয়া ছবির নাম আসে লণ্ডন থেকে, গল্প দক্ষিণ ভারত আর বাদ বাকী দুই বাংলার। ছবি যদি হয় ‘গ্লোবাল’, তবে সেখানে প্রাণের ঢাকা কোথায় আর ঢাকার ভালোবাসার গল্পই বা কোথায়। ভালোবাসার গল্পে ঢাকা যে ধূ ধূ প্রান্তর নয়, তার প্রমাণ মিলে ঘুড্ডি-তে, আজ বরং তার গল্প শোনাই।

ঘুড্ডি ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র। যারা ছবির নাম শুনেছেন কিনা মনে করতে পারেন না, তাদের জন্য আছে এই ছবির বিখ্যাত গান – চলো না ঘুরে আসি অজানাতে/ যেখানে নদী এসে থেমে গেছে। হ্যাপী আখন্দের গাওয়া এই ক্ল্যাসিক মর্যাদাপ্রাপ্ত গানের দৃশ্যায়নে কক্সবাজারে। শার্ট হাতে খালি গায়ে, খালি পায়ে দাড়ি-গোঁফসমৃদ্ধ নায়ক আসাদ নেচে নেচে গেয়ে শোনায় এই গান, পাশে থাকে হাতাকাটা ব্লাউজ পরিহিতা নায়িকা, যার নামেই সিনেমার নাম। ঘুড্ডি চরিত্রে সুবর্ণা মোস্তফা, আসাদ চরিত্রে রাইসুল ইসলাম স্বয়ং। গানের সাথে উদ্দাম নাচ নেই, স্বল্প পোষাকে নায়িকার শরীর প্রদর্শন নেই বরং ত্রিশ বছর পরে আজও সমুদ্রের পাড়ে গেলে প্রেমিক-প্রেমিকার যে রূপ সেই চিরন্তন দৃশ্যকেই ক্যামেরাবন্দী করেছেন পরিচালক, ফলে ঘুড্ডি সাধারণের প্রেমের গল্প হয়ে উঠতে পারে সহজে।

ঘুড্ডি সিনেমার দৃশ্যে আসাদ ও সুবর্ণা
ঘুড্ডি সিনেমার দৃশ্যে আসাদ ও সুবর্ণা

ছবির গল্প আবর্তিত হয় আসাদ এবং ঘুড্ডির প্রেমকে ঘিরে। আসাদ মুক্তিযোদ্ধা, বর্তমানে বেকার, অথচ বেকারত্ব তার প্রাণচাঞ্চল্যকে দমিয়ে রাখতে পারে না, তার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি সর্বদাই লক্ষ্যনীয়। অন্যদিকে নায়িকা প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হওয়া মেয়ে, যে নিজেকে বন্দী হিসেবেই দেখতে পায় এবং যে আসাদের ক্রমাগত মিথ্যে কথায় বিশ্বাস করে যায়। বিপরীতমুখি এই দুই চরিত্রের মধ্যকার প্রেমের সম্পর্কের বিভিন্ন দৃশ্যের মাধ্যমে পরিচালক তুলে ধরেন বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের একটা চিত্র ফুটে উঠে ছবির সংলাপে, চরিত্রগুলোর মাধ্যমে এবং ঘটনাপ্রবাহে।

১৯৮০-তে মুক্তিপ্রাপ্ত এ চলচ্চিত্রটি গতানুগতিকের বাহিরে কিন্তু বেশ আলোচিত। ছবির পরিচালক সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী। এটি তার নির্মিত তিনটি চলচ্চিত্রের প্রথম। দর্শক এবং সমালোচকের দৃষ্টিতে সফল এই ছবিটি এখন খুবই দুর্লভ। ইউটিউবে নেই, ডিভিডি-তেও নেই, এমনকি টিভি চ্যানেলেও প্রদর্শিত হয় না। কদাচিৎ অল্প কিছু দর্শক এই দুর্লভ চলচ্চিত্র দর্শনের সৌভাগ্য অর্জন করেন বিভিন্ন উৎসবের প্রদর্শনীতে। অথচ, সময়কে অতিক্রম করে গিয়েছে যে চলচ্চিত্র তার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ জরুরী।

ঘুড্ডি বাজারী চলচ্চিত্র নয়, কিন্তু ঘুড্ডি তৃপ্তি দিতে পারে, ছবির গল্পকে নিজের গল্প হিসেবে আপন করে নিতে পারে। ফলে দিন শেষে ঘুড্ডির মত চলচ্চিত্রই সত্যিকারের বাংলাদেশী ভালোবাসার চলচ্চিত্র হয়ে উঠে। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের এ ক্রান্তিকালে ঘুড্ডি হতে পারে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রেরণা, জাগিয়ে তুলতে পারে দেশাত্মবোধ, আর তাতে বেঁচে যেতে পারে দেশী চলচ্চিত্র শিল্প। দর্শককেও তখন আর দক্ষিণ ভারতীয় ভালোবাসা দেখে মন ভরাতে হবে না।

চলচ্চিত্রটি এখন ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। প্রকাশ করেছে জি সিরিজ।

(লেখাটি পাক্ষিক অনন্যায় প্রকাশিত, ছবি বিডিনিউজ২৪ থেকে সংগৃহীত)

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

3 Comments on “শত শত ঘুড্ডি চাই”

  1. আপনার কাছে কি ঘুড্ডি চলচ্চিত্রটির কোন সিডি আছে? অথবা, আপনি কি আমাকে জানাতে পারবেন, কিভাবে এই চলচ্চিত্রটির একটা সিডি যোগাড় করতে পারব। আপনি জানালে খুবই উপকৃত হবো। ধন্যবাদ।

    1. ভাই ফাহিম, ঘুড্ডি চলচ্চিত্রের কোন সিডি কখনো তৈরী করা হয় নি বলে জানি। এটি এখনো ফিল্ম ফরম্যাটে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। বিভিন্ন উৎসবে ছবিটি দেখানো হয় – দেখতে চাইলে সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখতে হবে। এছাড়া মুভিয়্যানা ফিল্ম সোসাইটির বেলায়েত হোসেন মামুন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। তারা একাধিক উৎসবে এই ছবিটি দেখিয়েছিল – হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন।
      ভালো থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *