গত শতকের ত্রিশের দশকে মহামন্দা নিয়ে নির্মিত মুভিগুলো দেখতে বেশ ভাল লাগে। মহামন্দার রূপ কিরকম ছিল সে বিষয়ে একটা হালকা ধারনা পাওয়া যায়। এর আগে মহামন্দার সময়কার একটি বাস্তব ঘটনা ও চরিত্রকে কেন্দ্র করে নির্মিত মুভি ‘সিনড্রেলা ম্যান‘ দেখে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলাম যে মহামন্দার উপর এবং সময়ে নির্মিত মুভি কি কি হয়ছে সে বিষয়ে বেশ ঘাঁটাঘাটি করেছিলাম। সেই সময়েই জেনেছিলাম মহামন্দার সময়ে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি মোটামুটি মহামন্দার প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল, পাশাপাশি কিছু বিনোদনমূলক খেলাও। এর অন্যতম প্রধান কারণ দরিদ্র-ক্লিষ্ট মানুষ তাদের দু:খ বেদনাকে ভুলে থাকতে উপার্জনের একটা অংশ দিয়ে বিনোদন কিনতো। ফলে বক্সিঙ, রেস ইত্যাদি জনপ্রিয় ছিল সেই সময়। সিবিস্কুট মহামন্দার সময়কার সত্যি কাহিনী নিয়ে নির্মিত সিনেমা।
তিনজন মানুষ – প্রকৃতি, পরিচয়ে এরা প্রত্যেকেই ভিন্ন। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে রয়েছে একটা মিল। এরা প্রত্যেকেই হতাশাগ্রস্থ। এই তিনজন মানুষকে একত্র করল একটি ঘোড়া যার নাম সিবিস্কুট, তারপর পাল্টে দিল তাদের জীবন – হতাশাগ্রস্থের মধ্যে প্রাণ সঞ্চারিত হল, জীবনের মানে খুজে পেল – এক কথায় বলতে গেলে এটাই সিনেমার গল্প।
তিনজন মানুষের একজন হল রেড পোলার্ড, সে একজন জকি। জন্ম হয়েছিল বেশ স্বচ্ছল পরিবারে, ত্রিশের মহামন্দায় রীতিমত পথে বসতে হল। নিজের ঘোড়ায় চড়ে যার জীবন শুরু হয়েছিল, তাকে রুজি জোগাড়ের জন্য বাবা-মা একজন হর্স ট্রেনারের কাছে দিয়ে দিলেন। জকি হবার জন্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশী লম্বা রেড ঘোড়ার রেস খেলার পাশাপাশি অবৈধ বক্সিং ও খেলতো, টাকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু একের পর এক রেস এবং চাকরী হারানোর ফলে খুব একটা মানসিক শান্তিতে ছিল না সে।
একই রকম অশান্তিতে ছিল প্রচন্ড ধনী চার্লস হাওয়ার্ড। বাইসাইকেল বিক্রি এবং সারাইয়ের কাজ করতেন, ঘটনাচক্রে একদিন একটি মোটরগাড়ি সারানোর দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন। তারপর নিজের মোটরগাড়ির ব্যবসা। কিন্তু মহামন্দায় ধাক্কা খেলেন তিনিও, যদিও পথে বসতে হল না। একমাত্র ছেলে একাকী গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেল আর স্ত্রীও তাকে ডিভোর্স করল। হতাশা দূর করার জন্যই ঘুরতে ঘুরতে মার্সেলার সাথে পরিচয়, বিয়ে এবং তার মাধ্যমে ঘোড়ার দিকে আকৃষ্ট হলেন।
তৃতীয় জন টম স্মিথ। তিনি একজন হর্স ট্রেইনার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি একজন আগান্তুক মাত্র। আহত একটি ঘোড়াকে বাচিয়ে, সারিয়ে তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, হাওয়ার্ড তাকে আস্তাবলের ঘোড়া দেখাশোনার জন্য নিয়োগ করল। তারপর তার পরামর্শে এলো সিবিস্কুট নামের ঘোড়া, তার জকি হিসেবে এল রেড পোলার্ড। তিনজন পুরুষ, একজন মহিলা আর একটি ঘোড়া নিয়ে নতুন একটি পরিবার যেন।
যে ঘোড়া রেস খেলবে সে ঘোড়ার কতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকা জরূরী। বিশেষ করে তার উচ্চতা। রেসের ঘোড়া আলাদা ভাবে ব্রিড করা হয়। তেজী, খেলুরে কোন ঘোড়ার সাথে মানানসই ঘোড়ার ব্রিডিং এ যে ঘোড়া জন্ম নেয় সেই ঘোড়া জন্মগত ভাবে রেস খেলার উপযুক্ত হয়। এ কারণে সেরা ঘোড়াগুলোর সাথে ব্রিড করার একটা চেষ্টা ঘোড়ার মালিকদের থাকে।
সিবিস্কুট-ও ম্যান-ও-ওয়ার নামের সেরা একটি ঘোড়া থেকে ব্রিড করা হয়েছিল। কিন্তু কোন এক কারণে সিবিস্কুট রেসের ঘোড়ার মত উচ্চতাসম্পন্ন হয় নি। ফলে রেস খেলার যোগ্যতা তার ছিল না। বরং তাকে ব্যবহার করা হল অন্যান্য রেস হর্সের ট্রেইনিং এর জন্য। সেখানে তাকে শেখানো হল কিভাবে রেসের মধ্যে হারতে হয় – উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে অন্যান্য রেস হর্সের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করা। এই ট্রেইনিং-ই সিবিস্কুটকে যে কোন রেসে অবধারিতভাবে হারতে শেখালো। এইরকম একটি ঘোড়াকে পাল্টে দিয়ে তৎকালীন সময়ের সেরা রেস হর্স বানানোর কাজটি-ই একটি সিনেমার গল্প হয়ে গেল।
সিবিস্কুটের এই কাহিনী নিয়ে সিনেমা হয়েছে সেই ত্রিশের দশকেই, ডকুমেন্টারী হয়েছে, সিবিস্কুট: অ্যান অ্যামেরিকান লিজেন্ড নামে বই লেখা হয়েছে। সেই বই অবলম্বনেই প্রযোজক, পরিচালক গ্যারি রস স্ক্রিপ্ট তৈরী করেছেন। গ্যারি রসকে চিনবেন হয়তো, তিনি সম্প্রতি হাঙ্গার গেমস পরিচালনা করেছেন।
রেড পোলার্ড চরিত্রে দারুন অভিনয় করেছে স্পাইডারম্যান খ্যাত টবি ম্যাগুইরে। হাওয়ার্ড চরিত্রে অভিনয় করেছে জেফ ব্রিজেস। মাঝখানে বিনোদন দিয়েছে রেস ধারাভাষ্যকার চরিত্রে উইলিয়াম এইচ ম্যাসি। কিভাবে একাই একটা রেডিও চালাতে হয়, সাউন্ড ইফেক্ট দিতে হয় তা শেখা গেল তার কাছ থেকে। অনবদ্য অভিনয় তার। অসাধারণ কিছু ডায়লগ আছে এই সিনেমায়। হতাশাগ্রস্থ মানুষের জীবন পাল্টে দিতে পারে এমন একটি ডায়লগ এরকম –
You don’t throw a whole life away just ’cause he’s banged up a little
এই রকম দারুন সংলাপের সাথে আছে মিউজিক। গল্পটা মেদহীন, বলিউডের মত অনর্থক কোন প্রেমকাহিনী দিয়ে গল্পকে ট্র্যাকচ্যুত করার চেষ্টা হয় নি। মহামন্দার সময়ে যে সিবিস্কুট হতাশাগ্রস্থ আমেরিকানদের আশার প্রতীক হয়ে দাড়িয়েছিল সেই সিবিস্কুটকে নিয়ে তৈরী টানটান উত্তেজনার এই সিনেমাটির ভাগ্য বেশ খারাপ। অনেকগুলো ফেস্টিভ্যাল এমনকি সাতটি ক্যাটাগরীতে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হলেও পুরস্কার জিততে সক্ষম হয় নি। ক্ষতি কি, দর্শক হিসেবে তাতে একবিন্দুও ক্ষতি হয় নি।
ওয়াও … পড়েই ভালো লেগে গেল … দেখার লোভ সামলাতে পারছিনা … দেখার পর আবার কমেন্ট করার আশা প্রকাশ করছি … (ফেলুদা সিরিজ নিয়ে রিভিউ চাই, কয়েকদিন আগে “রয়েল বেঙ্গল রহস্য” দেখলাম, চমৎকার লেগেছে, ছোটবেলায় “ফেলুদা ৩০” সিরিজ দেখেছিলাম, সেগুলোও বেশ ছিল… আপনার কাছ থেকে এ বিষয়ে আরও জানতে চাই)
ধন্যবাদ রকীব।
এমন একটা সিনেমা যেটা হতাশার সময় বেশ ভালো উৎসাহ দিতে পারে, অনুপ্রেরণা জোগায়।
দেখে জানাবেন 🙂
গত সপ্তাহে দেখলাম। প্রথমটাই একটু ধীর মনে হয়েছে, এই যা। রেডিও জকি+সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের অভিনয়টা প্রাণবন্ত লেগেছে। রেড পোলার্ডের অভিনয়ে টবি ম্যাগুইরে বেশ ভালই করেছে, হাওয়ার্ড এর চরিত্রায়নও খারাপ না। কোচটাকেও ভালো লেগেছে।
ভাল ছবি, দেখে অনুপ্রাণিত হবার মতন ঘটনা।
মজার বিষয় হল আপনার থেকে নাম নিয়ে গতকালই দেখলাম মুভিটা । শুরুতে কিছুটা স্লো মনে হলেও পরে ভালো লাগলো । খুব ভালো ১ টা মুভি । ধন্যবাদ ।
হুম। গল্পে ঢুকতে একটু সময় নিয়েছে বটে, কিন্তু তাই বলে স্লো মনে হয় নি। প্রথমাংশ থেকে ভিন্ন সিনেমা হতে পারতো।
ধন্যবাদ সাজিদ 🙂
ধন্যবাদ দারাসিকো ভাই এত সুন্দর একটা ছবি রিকমেন্ড করার জন্য। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে সিনেমাখোড় গ্রুপে আপনার পোস্ট পড়ে ডাউনলোড দিয়া রাখসিলাম। গতকাল দেখলাম। অসাধারন। ছবি শেষে আরো আধাঘন্টা নেটে ঘাটাঘাটি করলাম ঘোড়া টা নিয়া।আমি মনে করসিলাম লাস্টের রেসটা বোধহ্য় সিনেমার ক্লাইমেক্স বানাইতে চাইসে বাট পরে দেখী সত্য ঘটনা।
দারাশিকো’র ব্লগে স্বাগতম ইমরান শাওন 🙂
আমার রিকমেন্ডে একটা ভালো সিনেমা দেখেছেন – এটা আমার জন্য বিশাল প্রেরণা। ভালো থাকুন। আবারও আসবেন 🙂
সরি দারাসিকো ভাই নয় দারাশিকো ভাই হবে….
ওই হৈল 🙂 ব্যাপারনা 🙂
সিবিস্কিট দেখেছিলাম গত বছর, প্রথম খানিকটা মিস করে থাকতে পারি, যেহেতু টিভিতে চলছিল। গল্পকথনটা আমার খুব ভাল লেগেছিল, আর অভিনয়ও সবার অনবদ্য। ভাল মোটিভেশনাল মুভি বটে।
রিভিউটা ভাল লাগল, মন্তব্য না রেখে পারলাম না। সিনেমা প্রচুর খাই, ইদানিং একটু রিভিউ-টিভিউ লেখার চেষ্টা করছি। আপনার মত যারা লেখেন তাদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করছি। 🙂