এককালের নামি অভিনেত্রি, আর একালের নামি পরিচালক অপর্না সেনের সর্বশেষ সিনেমা সিনেমা ‘ইতি মৃণালিনী’। বড় পর্দায় আলোড়নের পর গত ৮ ডিসেম্বর কলকাতায় ডিভিডি মুক্তি পেয়েছে সিনেমাটির।
সিনেমার তারকাদের অন্দরমহলের কাহিনি। এমন কাহিনি নিয়ে সিনেমা তো কম হলো না। তারকাদের বেসামাল আবেগের ছড়াছড়ি নিয়ে কথাও কম নয়। পত্র-পত্রিকার কেচ্ছা আর সিনেমা জগতের মানুষকে নিয়ে বানানো এইসব সিনেমা দেখে এই জগত সম্পর্কে সমাজে একটা গড়পরতা ধারনাও গড়ে উঠেছে।ইনডিয়ার এ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেই সিনেমা জগতের মানুষ নিয়ে সত্যজিত রায় বানিয়েছিলেন ‘নায়ক’, ঋতুপর্ণ ঘোষ বানিয়েছেন ‘আবহমান’-এর মতো উত্তির্ন সিনেমা। সেই পশ্চিমবঙ্গের ড্রইংরুমে এবার মাসখানেক হলো ঢুকে পড়েছে অপর্ণার ‘ইতি মৃণালিনী’র ডিভিডি।
এককালের বানিজ্যিক সিনেমার সফল অভিনেত্রি মৃণালিনী। দির্ঘ অবসরের পরে নবিন পরিচালক ইমতিয়াজ চৌধুরির সিনেমায় অভিনয় করে আলোচনায় ফেরেন। কিন্তু পরের সিনেমাটির কেন্দ্রিয় চরিত্র থেকে ছিটকে পড়েন মৃণালিনী। বর্তমান প্রেমিক ও পরিচালক ইমতিয়াজ চৌধুরি’ই তাকে বাদ দেন নিজের সিনেমা থেকে।
মৃণালিনী ‘অপমানিত’ বোধ করেন। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নন’– মরন চিরকুট লিখে ঘুমের বড়ি গলায় ঢেলে যাওয়ার আগে নষ্ট করতে চান সব স্মৃতি। কাহিনির এইটুকু পথ হেটে আসা জরুরি ছিলো পরিচালক অপর্ণার জন্য। কারন পরিচালকের উদ্দেশ্য; দর্শককে মৃণালিনীর স্মৃতিতে ভাসিয়ে নিয়ে চলা। ফ্লাশব্যাক।
এই সিনেমায় অন্য সবকিছু ছাপিয়ে উঠে এসেছে মৃণালিনীর ব্যর্থ প্রেম। মৃণালিনীর জীবনে প্রেম এসেছে অন্তত চারবার। একদম যৌবনে সিনেমায় অভিনয় শুরুর আগে- নকশাল ক্লাসমেট অভি (সাহেব ভট্টাচার্য), যে কিনা নকশাল বিদ্রোহ দমনের সময় পুলিশের গুলিতে মারা যায়। পরের জন সিদ্ধার্থ সরকার (রজত কাপুর), একজন নামজাদা চিত্র পরিচালক। তার পরিচালনায় অভিনয়ের জগতে আসেন মৃণালিনী। প্রথম অভিনয়ই জিতে নেন রাষ্ট্রিয় পুরস্কার। তৃতিয় প্রেমিকটি সাউথ ইনডিয়ান উপন্যাস লেখক, নাম চিন্তন নায়ার (কৌশিক সেন)। সবশেষে বার্ধক্যে এসে তার চেয়ে কমবয়েসি সেই ইমতিয়াজ চৌধুরীর (প্রিয়াংশু চ্যাটার্জি) প্রেম।
এই চার প্রেম মৃণালিনীকে দিয়েছে চার ধরনের অভিজ্ঞতা ও অভিঘাত। প্রথম প্রেমে ভালোবাসার পাশাপাশি স্বপ্ন ছিল অনেক, বাস্তবতার ‘কষাঘাত’ তখনও অপরিচিত। দ্বিতিয় প্রেম সামাজিক দৃষ্টিতে অবৈধ, এবং অবাধ্য। স্ত্রি এবং দুই সন্তানের জনক সিদ্ধার্থ সরকারকে প্রেমিক হিসেবে মেনে নিতে মৃনালিনীর আপত্তি ছিল না– ভালোবাসা এবং সংসারই সেখানে মুখ্য ছিল। মিডিয়ার চক্ষুকে এড়ানোর জন্য কালিঘাটে বিয়ে এবং নিজের সন্তানকে নিঃসন্তান ভাইয়ের কাছে রেখে মানুষ করার চেষ্টা থাকলেও শেষ পর্যন্ত মিডিয়ার মুখ বন্ধ রাখা যায়নি, রক্ষা হয়নি সেই গোপন প্রেম ও সেই সন্তানের। বছরের পর বছর আশা দিয়ে শেষ পর্যন্ত বৈধ স্ত্রির কাছেই ফিরেছে সিদ্ধার্থ। তাদের মেয়েটিও মারা যায় বিমান দুর্ঘটনায় ।
মৃণালিণীর মাও কালিঘাটের মন্দিরে মালা বদল করে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু পান নাই সামাজিক স্বিকৃতি। দুই প্রজম্মের মাঝে কতো অমিল- কিন্তু তারা যেন ট্রাজেডির একই সুতোয় গাথা।
সেই ট্রাজেডিতে পরিচালক সিদ্ধার্থ সরকারের চরিত্র কথা তোলা যায়। সামাজিকতা, নারির অবমাননা এবং গোপন কামনা-বাসনার এই দোলাচল চিরন্তন। যতক্ষন পর্যন্ত নারিকে গোপনে রক্ষিতা হিসেবে রেখে সংসার রক্ষা করা যায় ততক্ষন সব ঠিক আছে। কিন্তু যখন সেই নারিকে নিয়ে ঘর করার কথা ওঠে, তখন যাবতিয় সিদ্ধান্তহিনতা। শেষ পর্যন্ত ঘরের পুরুষ ঘরে ফিরলেও ‘কালিমা’ পড়ে শুধু ভালোবাসার জন্য সম্মান বিসর্জন দেয়া নারির গায়ে। সেই হদিস সমাজ সংসারে কে রাখে! কিন্তু সমাজে বৈধ স্ত্রির সাথে মনের এবং মতের মিল না হলেও সামাজিকতা রক্ষার নামে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা অন্যায়-অবৈধ নয়। আবার ‘বৈধ’ স্ত্রি থাকা সত্ত্বেও অন্য নারিতে আসক্ত হওয়াও যেন স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে দোষ এবং ক্ষতিপুরনের দায় কি শুধু নারির? নারি দায় না নিলে এর দায় আর কে নেবে! অপর্ণা এই নিয়ে প্রশ্নসংকুল বা উচ্চকিত নন। কেন?
মৃণালিনীর তৃতিয় প্রেম নিষ্কাম, প্রেমিক লেখক চিন্তন। ঘরে তার পঙ্গু স্ত্রি, কিন্তু সে ধৈর্য্যের প্রতিক, পত্নি অন্তপ্রাণ। মৃণালিনীর পাওয়া-না পাওয়ার দুনিয়ায় ভালোবাসার প্রকৃত রূপটি ফুটে ওঠে চিন্তনের মধ্য দিয়ে। যেখানে প্রেম মানে কামনা পুরন নয়, প্রেম মানে সহযোগিতা, নির্ভরতা, বিশ্বাস। কিন্তু এই প্রেমের স্বরূপ ঐতিহাসিকভাবেই অস্পষ্ট। সেই অস্পষ্ট প্রেমই আস্থা। বৈচিত্র্য মানুষের মন! শোকে দৃঃখে মৃণালিনীর ডাকে শেষ পর্যন্ত এই একজনই সাড়া দেয়। চতুর্থ প্রেমিক ইমতিয়াজের প্রেম কি সত্যিই প্রেম না সাময়িক মোহ – সে ব্যাপারে সন্দেহ জাগে। ইমতিয়াজের প্রতি মৃণালিনীর অসম ভালোবাসা- সেটা মৃণালিনী চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো স্খলন, এই নিয়ে তার মাঝে কোন দ্বন্ধ নাই।
এই সিনেমায় অভিনয়ের ক্ষেত্রে বার্ধক্যের অর্পনা সেনকে ছাড়িয়ে গেছেন তরুনি কঙ্কনা সেন শর্মা। অপর্না সেনের অভিনয় দর্শকের সাথে যোগাযোগ তৈরি করার মত নয়। তার অভিনয়ের অংশগুলো তরুনি মৃণালিনীর প্রতিনিধিত্ব করে না। এই মৃণালিনী যেন অন্য কেউ। চার প্রেমিক চরিত্রের চারজনের কাছ থেকে ভালো অভিনয় আদায় করে নিয়েছেন অপর্ণা।
অপর্ণার আগের সিনেমাগুলোর মতো ধারালো সংগিত আর চিত্রগ্রহন উপভোগ্য। নতুন যা বলার আছে, সেটা এই সিনেমার একটি অন্যতম হ্যা-বোধক দিকও, এটা হলো নির্মান কাহিনি। এই প্রথমবারের মতো অপর্ণা সেন একজন নতুন চিত্রনাট্যকারকে নিয়ে চিত্রনাট্য লিখিয়েছেন, সিনেমার সহকারি পরিচালকও সেই ব্যক্তি, তিনি রঞ্জন ঘোষ। অপর্ণার উদ্যোগ অনেকটা হাত ধরে প্রবেশ করিয়ে দেয়ার মতো।
অপর্ণা নিজে এ পর্যন্ত তিনবার বিয়ে করেছেন। এই মৃণালিনী কি পরিচালকের আত্মজৈবনিক? সেটা ভেঙ্গে বলেন নাই অপর্ণা সেন। তবে অপর্ণা এটাও বলেছেন এই সিনেমার অনেক ঘটনায় বাস্তবেই তার জিবনে ঘটেছিল। এটা বোধহয় কনফেশন নয়, শিল্পি জীবন নির্মিত সিনেমায় কনফেশনের কোন বালাই চোখে পড়ে না। তারা নৈতিকও নন-সামাজিকও নন। সিনেমা বা বৃহদ্বার্থে শিল্পজগতে সুক্ষ্মানুভূতির যে দোহাই, আসলে কি সেটা ঘটে যাওয়া সব কিছুকে জায়েজ করে? সে প্রশ্নের উত্তর এই সিনেমায় নাই। এইসবের সমান্তরালে এই কাহিনিতে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির যে কথাগুলো উঠে এসেছে, তা যেন চিরন্তন। আজকে যে অনেক দামি কালকেই সে মুল্যহিন, অপাংক্তেয়।
মৃণালিনীকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, অভিনয় ছেড়ে দিলেন কেন? মৃণালিনীর উত্তর ছিলো, তিনি মানিক’দার (সত্যজিত রায়) ডাকের অপেক্ষা ছিলেন। মানিক’দা মারা যাওয়ায় বুঝলেন এই আশা পুর্ন হবার নয়। তাই মৃণালিনী সিনেমা জগতকে বিদায় জানালেন। সিনেমার আগের অংশগুলোতে প্রেমঘটিত সুখ আর শোকের যে প্রতাপ, দর্শক তো আগেই ধরে নেয় ব্যক্তিগত শোকে মৃণালিনী সিনেমাজগত ছেড়ে গেছে। সেখানে সত্যজিত রায়-কে জড়িয়ে উক্তিটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নাই। নাকি, বাণিজ্যিক সিনেমার নায়িকা নিজেও বাণিজ্যিক সিনেমাকে মেনে নিতে পারেন না!
well and good dear. going on . go ahead .
আসলাম ভাইইইইইই 😀 😀
কি যে ভালো লাগলো আপনাকে দেখে 😀 😀
থ্যাংকু আসলাম ভাই 🙂 অনেক ধন্যবাদ
vi, boraborer moto khube valo hoise lekha. ektu correction kore nien – satyajit mone hoy Nayok name ekta movie banaisen, uttom kumarer ovinito.
ধন্যবাদ ভাইজান – ভুলটা ধরায়া দেয়ার জন্য, নজরে পড়ে নাই প্রথমবার 🙂
valo lahlo review ta…moive ta ase kase but akono dekha hoi nai…dekhbo vabsi…
দারাশিকো ব্লগে স্বাগতম সূর্য 🙂
দেখে ফেলুন আর মাঝে মধ্যে ঘুরে যান আমার এই দুনিয়াটা 🙂
movie ta jotil. apnar post er agai dekhe felsi. but apnar lekha poray aro clear holo.
দারাশিকো’র ব্লগে স্বাগতম অন্তহীন 🙂
আপনার নামেও একটা সিনেমা আছে. দেখেছেন?
আমার একটা পোস্টও আছে অন্তহীন নিয়া 😛
আবার আইসেন 🙂