দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন সিনেমার চিঠি লেখার শিক্ষা যেভাবে কাজে লাগাতে পারেন

দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন সিনেমায় এন্ড্রু চিঠি লিখে চলছে

দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন সিনেমার নাম শুনেনি এমন সিনেমাপ্রেমী পাওয়া দুষ্কর। সারা দুনিয়ার সিনেমার ডেটাবেজ আইএমডিবি-তে দীর্ঘদিন ধরে এক নাম্বার অবস্থানে রয়েছে এই সিনেমাটি। নানা কারণেই সিনেমাটি সারা বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। এই সিনেমা থেকে দর্শক নানারকম শিক্ষা নেন, যেমন অ্যান্ড্রুর মতো কঠোর অধ্যাবসায়ের সংকল্প গ্রহণ করেন কেউ কেউ। আবার সিনেমা দেখে নতুন করে বাঁচতে শিখেন কেউ, যেভাবে বেঁচেছিল বিল। আমি বরং ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে বলি।

দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন সিনেমার ঘটনা

স্ত্রীকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত অ্যান্ড্রুকে শশাঙ্ক প্রিজনে পাঠানো হয়। ঘটনার এক পর্যায়ে তাকে শশাঙ্ক প্রিজন লাইব্রেরিতে দায়িত্ব দেয়া হয়। লাইব্রেরিতে এসে অ্যান্ড্রু আবিষ্কার করে – লাইব্রেরিটা পুরাতন ও জরাজীর্ণ বই দিয়ে ভর্তি। নতুন বই যোগ করা হয় না বহু বছর ধরে, লাইব্রেরির উন্নয়নের জন্য নেই কোন অনুদানও। অ্যান্ড্রু যোগাযোগ করে প্রিজনার মর্টন এর সাথে। অনুমতি চায়, প্রত্যেক সপ্তাহে একটি করে চিঠি লিখবে লাইব্রেরিতে বই কেনার অনুদান চেয়ে। অনুমতি পাওয়া যায়। অ্যান্ড্রুও চিঠি লিখতে থাকে।

আপনারা যারা সিনেমাটি দেখেছেন, তারা জানেন, অ্যান্ড্রুর আবেদনে কর্তৃপক্ষ সাড়া দিয়েছিল। স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে। অ্যান্ড্রুর প্রত্যেক সপ্তাহের চিঠি পেয়ে একসময় কার্টন ভর্তি পুরাতন বই আর মাত্র দুইশ ডলার অনুদান হিসেবে পাঠিয়ে দেয়৷

ধারণা করুন তো, অ্যান্ড্রু কতদিন চিঠি লিখার পর এই উত্তর পাওয়া গিয়েছিল?

ছয় বছর। চিন্তা করা যায়?

অ্যান্ড্রু অবশ্য এবার আরও উৎসাহ পায়। সে সপ্তাহে একটির পরিবর্তে দুইটি করে চিঠি লিখতে থাকে। এক পর্যায়ে দেখা যায়, এক রুমের লাইব্রেরি কয়েকটি রুমের বিশাল লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সেখানে বসে বই পড়ার পাশাপাশি রয়েছে হেডফোনে গান শোনার সুবিধাও।

এন্ড্রুর এই ঘটনাটার একটি দৃশ্য দেখতে পারেন:

যে শিক্ষাটি গ্রহণ করা যায়

অ্যান্ড্রুর এই কাজটিকেই আমি শিক্ষা হিসেবে দেখতে চাচ্ছি। আমাদের আশেপাশে কত সমস্যা, এর ভোগান্তির শিকার হই আমরাই, কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার সমালোচনা করি, কিন্তু অ্যান্ড্রুর মতো কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে পারি না। কারণ, আমরা অ্যান্ড্রুর মত চিঠি লিখতে চাই না।

আমরা চিঠি লিখি না বা লিখতে চাই না, কারণ চিঠি লিখে কিছু হয় সেটা আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। চিঠি লিখে স্কুল বা সেতু পেয়ে যাওয়ার অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনা আমাদেরকে আরও অবিশ্বাসী করে তুলেছে। তবে আমি কিছু আশার কথা শোনাতে পারি।

চিঠি লিখে কি উপকার হয়?

আমাদের জনকল্যাণ সংক্রান্ত ইস্যুগুলো সাধারণত সরকারী বিভিন্ন দপ্তর কর্তৃক সমাধান করা হয়ে থাকে। সহজভাবে বললে, এ সকল অফিসই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ। এই সরকারি অফিসগুলোতে চিঠিপত্র গ্রহণ করে রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করার নিয়ম রয়েছে এবং এই নিয়ম সাধারণত পরিপালন করা হয়ে থাকে। আপনি যদি কোন চিঠি প্রেরণ করেন তবে সেটা গ্রহণ করা হবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। গৃহীত চিঠি পাঠিয়ে দেয়া হবে প্রাপকের দপ্তরে এবং এই তথ্যও লিপিবদ্ধ করে রাখা হবে৷

ধরা যাক, আপনি কোন একটি অফিসের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি লিখলেন। চিঠিটি তার দপ্তর পর্যন্ত অবশ্যই যাবে। মহাপরিচালক মহোদয় চিঠিটি পড়ুন বা না পড়ুন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অধীনস্ত কাউকে বা সেই কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন বিভাগকে দায়িত্ব প্রদান করে চিঠিটি পাঠিয়ে দিবেন। আমাদের চিঠির কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায় এই পর্যায়ে এসে। সাধারণত যে কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোন ব্যবস্থা নেন না, কখনও গুরুত্ব না দিয়ে ফেলে রাখেন, কখনও হারিয়ে ফেলেন। প্রত্যেকটি চিঠির জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে এই সমস্যা হতো না, কে না জানে, জবাবদিহিতার অভাবই এ দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা।

তবে, সকল কর্মকর্তা এরকম দায়িত্বহীন আচরণ করেন না। অনেকেই শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তবে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। কিছু কর্মকর্তা থাকেন, যিনি সত্যিই খুব সিনসিয়ারলি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। আর কিছু অসাধু কর্মকর্তা তো আছেনই। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে চিঠিটি ফেলে রাখবেন বা হারিয়ে ফেলবেন। কী হবে সেটা নির্ভর করতেছে আপনার ভাগ্যের উপর।

সুতরাং, আপনি যদি কিছুদিন অপেক্ষা করে পুনরায় চিঠি পাঠান, তারপর আবার পাঠান এবং পাঠাতে থাকেন, তাহলে টনক নড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অ্যান্ড্রুর মত ছয় বছর লাগবে – এটা আমার বিশ্বাস হয় না। হয়তো পাঁচ ছয়টি চিঠির প্রয়োজন হতে পারে।

কিভাবে পাঠাবেন

এই চিঠি পাঠানোর জন্য ডাকবিভাগের হলুদ খাম হলো সবচেয়ে সস্তা কিন্তু কার্যকর উপায়। এক পৃষ্ঠায় চিঠি লিখুন, পাঁচ টাকা মূল্যের একটি খামে ভরে ডাকবাক্সে ফেলে দিন।

যদি বিষয়টি কোন পাবলিক ইস্যু হয় যার কারণে আপনি একা নন, অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন, তাহলে একাধিক ব্যক্তির সহায়তা নিয়ে অধিক পরিমাণে চিঠি পাঠান। কূটনৈতিক কোন ঝামেলা না থাকলে দ্রুত কাজ হবে আশা করা যায়। এমনকি, এলাকাভিত্তিক বা ইস্যুভিত্তিক ফেসবুক বা ইমেইল গ্রুপে চিঠির ফরম্যাট তুলে দিতে পারেন, তাহলে আগ্রহী ব্যক্তির জন্য চিঠি লিখতে সহজ হবে।

গুরুত্বপূর্ণ একটি টিপস

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ টিপস দেই। আপনার প্রেরিত চিঠির কপি সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিকে দিন এবং চিঠির শেষে ‘অনুলিপি প্রেরিত:’ শিরোনামের অধীনে তার তালিকা দিন। এ সকল ব্যক্তি যদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়, তাহলে সর্বোত্তম।

ধরা যাক, আপনি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের নিকট একটি সমস্যা তুলে ধরে চিঠি লিখলেন। তার অনুলিপি পাঠাতে পারেন, যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রীকে এবং মন্ত্রনালয়ের সচিবকে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও মন্ত্রী বা সচিব মহোদয়ের দপ্তর থেকে চিঠিটি ফরোয়ার্ড হয়ে এলে তখন গুরুত্ব না দিয়ে উপায় থাকে না।

আরেকটি পরামর্শ

আরেকটি পরামর্শ দিতে চাই। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিঠিতে সমস্যা সম্পর্কে গুছিয়ে লিখুন। স্পষ্ট ভাষায়। আগোছালো বক্তব্যের চিঠি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। আর অবশ্যই সঠিক নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার ইমেইল ঠিকানা লিখুন। প্রয়োজন হলে যেন আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। যদি, নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চান, তাহলে কারণ উল্লেখপূর্বক ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ লিখুন এবং অতি অবশ্যই সমস্যা বা অভিযোগ স্পষ্টভাবে প্রমাণসহ লিখুন। চিঠিতে বিশ্বাসযোগ্য কিছু না থাকলে সেই চিঠি অতি অবশ্যই ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হবে।

খেয়াল করুন, আমি চিঠি লিখতে বলছি, ইমেইল নয়। কেন? ডিজিটাল বাংলাদেশের দূর্ভাগ্য হলো – এই ডিজিটাল নামেই হয়েছে, কাজে খুব বেশী নয়। মানুষ ডিজিটাল কমিউনিকেশনের ভদ্রতা শিখেনি। ফলে বেশিরভাগ লোক মেইল পাঠায় কোনরকম সাবজেক্ট, বডি ছাড়াই। মেইল প্রাপ্তির রিপ্লাই তো কোনভাবেই পাওয়া যাবে না। দুঃখজনক ব্যাপার হলো – প্রচুর সরকারি ইমেইল ঠিকানায় মেইল আদৌ পৌছায় না, বাউন্স করে। তাই মেইল পাঠান চিঠির পাশাপাশি। আর যদি জিমেইল, ইয়াহুর মত কোন ঠিকানা পান, তাহলে ইমেইল পাঠিয়ে দিন। পৌঁছানোর সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ।

আসলেই কাজ হয়?

আসলেই কি কাজ হয়? এই সন্দেহ সহজে দূর হবার নয়। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি – কম বেশি কাজ হয়। হয়তো আপনার পক্ষে সিদ্ধান্ত যায় নি, তাই আপনি ধরে নিয়েছেন – কর্তৃপক্ষ উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। আসলে, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে আপনার চিঠির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। নিষ্পত্তি হোক বা না হোক, আপনাত সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকবেন নাকি?

আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এভাবে চিঠি লিখি। এক পৃষ্ঠায় লিখে পাঁচ টাকার খামে ভরে এবং ইমেইলে এটাচমেন্টসহ চিঠি পাঠিয়ে দেই। কাজ হয়েছে কয়েকবার। সেটা আমার চিঠির কারণে নাকি স্বাভাবিক পন্থায়, তা আমার জানা নেই, কাজ যেহেতু হয়েছে, আমি ধরে নিয়েছি আমার চিঠির প্রভাবেই হয়েছে।

আপনাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন। কোন পরামর্শ থাকলে সেটাও লিখুন। গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে পোস্টে যুক্ত করে দেবো।

ভালো থাকুন। অ্যান্ড্রুর মতো সফল হোন। ধন্যবাদ।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *