আমি তোপসে নই, দারাশিকো। সত্যজিৎ এর চরিত্র নই, জলজ্যান্ত মানুষ। তবুও আমি তাপস রঞ্জন, কারন আমিই তোপসের শরীরে ফেলুদার সাথে বেড়িয়ে রহস্য, রোমাঞ্চের স্বাদ নেই। কিন্তু ফেলুদা কে? আমাদের আগের যুগের মানুষদের ফেলুদা হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই যুগে যারা সিনেমা দেখেননি তাদের ফেলুদাই সেরা, কারণ তারা বই পড়েছেন এবং নিজের কল্পনায় ফেলুদাকে এঁকেছেন। আর আমরা যারা এ যুগের, তাদের ফেলুদা হলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। বই পড়লেও সব্যসাচী কারণ আমাদের চিন্তা ভাবনাকে সব্যসাচী চক্রবর্তীর মাঝে আটকে দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের গুণবান সন্তান সন্দীপ রায়। এই ফেলুদা ওরফে সব্যসাচী যে একজন ভ্রমণপিয়াসী ও ফটোগ্রাফার, সেটা জানার সুযোগ হয় মাহদীর কাছ থেকে, একইসাথে তার লেখা ভ্রমণ বইটিও পড়ার সৌভাগ্য হল।
ফেলুদার আফ্রিকা ভ্রমণ কেনিয়ায় ভ্রমণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। খুবই সীমিত পরিসরে লিখা বইয়ের প্রথম তিন চ্যাপ্টারে ভ্রমণের প্রস্তাবনা, প্রস্তুতি আর কেনিয়ায় প্রবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কয়েক বন্ধুর ভালোবাসায় সব্যসাচী এবং তার বন্ধু চিত্রভাণু একটি গোটা দলের সাথে ট্যুরিস্ট প্রোগ্রামের আওতায় কেনিয়া ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে যান। পূর্ব নির্ধারিত ভ্রমণ তাই সময় নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন ফেলুদা, সংক্ষেপে সেই বর্ণনাও দিয়েছেন। কেনিয়ায় প্রবেশের পর এক স্পট থেকে আরেক স্পটে ভ্রমণকে আলাদা চ্যাপ্টারে উপস্থাপন করেছেন।
নাইরোবি থেকে মাসাইমারার উদ্দেশ্যে যাত্রা, মাসাইমারায় প্রবেশ এবং মাসাইমারায় দুই দিনের ভ্রমণ নিয়ে তিন চার অধ্যায়। আছে এনিমেল মাইগ্রেশন নিয়ে দুটি চ্যাপ্টার, তার একটি হল মারা নদী পার হওয়া বিষয়ক। সেখানেই প্রথম মাসাইমারা গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয় ভ্রমণকারীদের। তারপর দুটো লেক ভ্রমণের অধ্যায় – লেক নাইভাসা এবং লেক নাকুরু। সেখান থেকে ফেলুদা যান অ্যাবারডেয়ার ন্যাশনাল পার্কে, সেখানে একটি গাছবাড়ি আছে যা জঙ্গলের মধ্যেই। এর মধ্যেই তাদের যাত্রার দিন ফুরিয়ে এসেছে, ভ্রমণকাহিনীও। শেষের দিকে তারা অ্যম্বোসেলীর দিকে যাত্রা করেন। শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাওয়া অ্যম্বোসেলী লেকের উপর দিয়ে গাড়ি ছুটিয়েও চলেন। মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো দর্শনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় ফেলুদার কেনিয়া তথা আফ্রিকা অভিযান।
আফ্রিকা ভ্রমণ শুনে যান কেউ ভুল না বোঝেন, তাই ব্যাখ্যা করে বলছি – ফেলুদা আফ্রিকায় গিয়েছেন ট্যুরিস্ট হিসেবে, এক্সপ্লোরার বা অভিযাত্রী হিসেবে নয়। তাই সুন্দরবন ঘুরে যেমন রয়েল বেঙ্গলের দেখা পাওয়া যায় না, তেমনি আফ্রিকার ভ্রমণেও তেমন উত্তেজনাকর কিছু ঘটে না। তবে আফ্রিকা যে কারণে বিখ্যাত – প্রচুর জন্তু জানোয়ারের দেখা পেয়েছেন ফেলুদা। শিকারের দৃশ্য পেয়েছেন একটিই – হায়েনার পাখি শিকার। এই জন্তু জানোয়ারের দেখা পাওয়ার বর্ণনাই গুরুত্ব পেয়েছে বেশি, মাঝে কিছু কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে একটু বিস্তৃত বর্ণনাও পাওয়া গেল। যেমন রিফট ভ্যালি। লক্ষ বছর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে যে অংশটুকু ভেঙে সরে গিয়েছিল সেটাই রিফট ভ্যালি। আরেকটি বিষয় হল খাদ্য শৃঙ্খলের পরিবর্তনে ঈগল পাখির সংখ্যায় নেতিবাচক প্রভাব।
ফেলুদার যে দিকটি এখানে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে তা হল তার ফটোগ্রাফি গুণ। এই দিকটি অজানা ছিল। দেখা গেল তিনি এত ভালো ছবি তোলেন যে নাইকন কোম্পানী তাকে এই ভ্রমণে ভালো ক্যামেরা এবং শক্তিশালী লেন্স দিয়ে সহায়তা করেছেন। তাই তার বর্ণনায় বারবার এসেছে তিনি কিসের ছবি তুলেছেন এবং সেটা কেমন হল তা। ফেলুদার তোলা এই ছবিগুলোর একটা অ্যালবাম আছে বইয়ের প্রথম অধ্যায়েরও আগে। আর আছে প্রত্যেক অধ্যায়ের শুরুতে ও শেষ একটি করে। এই সাজানোর বিষয়টি পছন্দ হয়নি। কারণ বর্ণনার সাথে মিলিয়ে ছবি দেখতে হলে বারবার ফিরতে হবে গোড়াতে। চ্যাপ্টারের শেষে সংশ্লিষ্ট ছবি উপস্থাপন বেশি সুবিধাজনক হত।
ফেলুদার এই ভ্রমণ স্বল্পস্থায়ী। তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়, আমি ফিরলাম ঢাকায়। কাকতালীয় ব্যাপার হল ফেলুদা ঘুরে এসেছিলেন এই অক্টোবর মাসেই,যখন আমি বইটি পড়ছি। মাঝে সময়ের ব্যবধান চার বছর।