আমি এই ঘটনাগুলো অবশ্যই বলবো। আমি মানুষগুলোর কথাও বলবো। অবশ্যই বলবো।
রমজান মাসের কোন একদিন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সদরঘাট গিয়েছিলাম। পৌনে ছ’টায় বাসে উঠেছি। ইফতারের আগে বাসায় পৌছানোর সম্ভাবনা একদমই শূন্য। শাহবাগ-শেরাটনের কুখ্যাত জ্যাম ঠেলতে ঠেলতেই ইফতারের সময় হয়ে গেল। ছোট ছোট ছেলেরা পানি-পানি করে চেঁচাচ্ছে। ইফতারের মিনিট পাঁচেক বাকি, হাফ লিটারের একটা বোতল কিনতে চাইলাম – মাত্রাতিরিক্ত দামের জন্য কেনা হল না। আরেক বিক্রেতাকে ডাকতেই পাশের সহযাত্রী লোকটি আমাকে বাধা দিল – ‘আমার কাছে পানি আছে’। আমি ভালো করে খেয়াল করলাম লোকটিকে।
বছর ত্রিশ হবে বয়স। মাথায় টুপি, থুতনীতে দাড়ি আছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। মাদ্রাসা পড়ুয়া লোক, বোঝা যায়। হাতে তার একটি শপিং ব্যাগ। আজান দিলে সেই ব্যগ থেকে বের করলেন পানির বোতল, এক চুমুক দিয়ে রোজা খুলে আমাকে দিলেন, আমি রোজা খুললাম। সে আরও কয়েকজনকে পানির বোতল দিয়ে সহায়তা করতে চাইল, কিন্তু সবার কাছেই পানি ছিল, কেউ নিল না।
এবার সে ব্যাগ থেকে বের করল ছোট করে কাটা পেয়ারা এবং শশা। যাত্রাপথে অপরিচিত কারও কাছ থেকে কিছু খেতে হয় না – এই বাক্যে আমার খুব বিশ্বাস, তাই নিজে খাই না, অপরকে খাওয়ার জন্য বলিও না। কিন্তু হুজুর ভদ্রলোক এই বাক্যে বিশ্বাসী নন – তিনি বারবার ‘নেন খান, আরও খান, এইটা তো খেলেন না, আরে খান অনেক আছে’ এইসব বলতে বলতে নিজে যা খেল তার চেয়ে বেশি আমাকে খাওয়ালো।
টুকটাক কথাবার্তাও হল – উনি নয়াবাজারে পাইকারী কাপড়ের ব্যবসা করেন। থাকেন মিরপুরে, বড় ভাই-ভাবীর সাথে। প্রতিদিন রোজা খুলেন রাস্তায়, তাই ভাবী এইসব খাবার দিয়ে দেন সকালে। কারওয়ানবাজারে মাগরিবের আজান দিল, আর উনি ফার্মগেটে তেজগাঁও কলেজের সামনে নেমে গেলেন – মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে আবার উঠবেন গাড়িতে। বাকী রাস্তার পুরোটাই আমি তার কথা, ব্যবহার, আন্তরিকতা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম।
অন্য ঘটনাটি একদম তরতাজা, মাত্র ঘন্টাখানেক আগে ঘটেছে। একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল বাসা থেকে বের হতে। রাস্তায় বেরিয়ে আর গাড়ি পাচ্ছিলাম না। অগত্যা, ভিন্ন রুটের গাড়ি ধরে আগারগাঁও মোড়ে এসে দাড়ালাম, আশা – হয়তো কোন একটা বাসে বা টেম্পুতে উঠে যেতে পারবো। কিন্তু এখানেও অনেক মানুষ, সব বাসের দরজা বন্ধ, টেম্পুতে ঝুলছে মানুষ। একটা প্রাইভেট কারে চারজন মানুষ, সেখানেও অনেক রিকোয়েস্ট করে একটি যুবক এবং তার সঙ্গে থাকা যুবতী উঠে পড়লেন। বাসের হেল্পারকে অনুরোধ করে একজন উঠে পড়ল বাসে। আমি দাড়িয়ে থাকলাম আরও অনেক মানুষের সাথে।
এমন সময় একটি মোটরসাইকেল এসে দাড়ালো। ‘মহাখালী-বনানী কেউ যাবেন?’ ‘আমি মহাখালী যাবো’ – কিছু না ভেবেই বললাম। ‘উঠুন’। এক নজরে হেলমেট পড়া মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। পয়ত্রিশের কম বয়স হবে। শার্ট-প্যান্ট পড়ুয়া, সাথে ব্যাগ। মুখভর্তি দাড়ি। উঠে বসতেই বাইক চালিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে পৌছে দিল মহাখালী ফ্লাইওভারের গোড়ায় নামিয়ে দিলেন। আমি শুকনো মুখে থ্যাংক ইউ বলতে পারলাম শুধু। তিনি চলে গেলেন ফ্লাইওভার দিয়ে বনানীর দিকে।
মোটরসাইকেলের পেছনে কাউকে তোলা বাংলাদেশের মত দেশে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পকেট থেকে মোবাইল-মানিব্যাগ পড়ে যায়, ব্যাগ থেকে ট্যাবলেট নেই হয়ে যায়, কখনো কখনো মোটরসাইকেলটাও দিয়ে দিতে হয়। তারপরও এই মানুষগুলো যেভাবে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষকে বিশ্বাস করে মোটরসাইকেলে নিচ্ছেন, সহযাত্রীকে ইফতারের ভাগ দিচ্ছেন তাদের জন্য অন্তরের অন্তস্থল থেকে দোয়া করি – যে নিয়্যতে তারা সহযোগিতা করছেন রাব্বুল আলামীন তা কবুল করুক। এই সকল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক। আমিন।
ছবি: ইন্টারনেট
Faith in humanity #Restored.
(Y)