বিস্কুটখেকো!

‘দুইটা টাকা দিবেন?’ – যে কোন জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পটে এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, সুতরাং সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে এই প্রশ্ন শুনে আমার মধ্যে কোন ভাবান্তর হল না। আমি ছেলেটির দিকে তাকালাম, বছর চার পাঁচের বেশী না বয়স।

‘কি করবা টাকা দিয়ে?’

‘বিস্কুট খাবো’ – উত্তর শুনে আমি মোটামুটি ভিমড়ি খেলাম। এর আগে প্রায় সবাই হয় ভাত নয়তো রুটির কথা বলেছে – এই ছেলের ক্ষুধা বিস্কুটের। কেন? আল্লাহ মালুম! কথা বলার মুডে ছিলাম না, ফলে প্রশ্ন করা হয় নি। প্রথম দিনের ঘটনা।

তৃতীয় দিনে দল থেকে ছুট হয়ে একাকী সৈকতে বসে ছিলাম ঘন্টা তিনেক। সমুদ্র নয়, মানুষ দেখেছি – ক্লান্তিহীন। হঠাৎ ‘দুইটা টাকা দিবেন, বিস্কুট খামু’ শুনে তাকিয়ে দেখলাম সেই ছেলেটি। দীর্ঘ সময় ধরে মানুষ দেখে দেখে আমার মন তখন ফুরফুরে – আমি হেসে ফেললাম।

‘ওই, তুমি কি শুধু বিস্কুট খাও? পরশুদিনও তো বিস্কুট খাওয়ার জন্য দুইটাকা চাইছিলা – বিকেলে, বিচে! মনে আছে? আমি কিন্তু তোমারে চিনছি!’

ছেলেটা যতটা না অবাক হল তার চেয়ে বেশী লজ্জা পেয়ে গেল। সেন্টামার্টিন্সে কেউ যদি থাকে তো বড়জোর দুই দিন, এক রাত। দুই রাত শেষে তৃতীয় দিনে একই লোকের কাছে বিস্কুট চেয়ে ফেলেছে – এই লজ্জায় সে কুন্ঠিত হয়ে ছোট্ট হাসল, কিন্তু উত্তর দিল না। মিনিট দশেক আমি তার সাথে নানারকম মজা করার চেষ্টা করলাম – সে পুরো সময়ই নৈর্ব্যক্তিক আচরন করে গেল।

সেন্টমার্টিন্সে এই একটা বিষয় আমি ঠিক মিলাতে পারি নি। দ্বীপে টাকা রীতিমত উড়ছে। পর্যটকরা আসছে, সাধারণ সব জিনিস উচ্চমূল্যে কিনছে – কিন্তু এই দ্বীপে প্রচুর দরিদ্র মানুষ এবং প্রচুর শিশু ভিক্ষা করছে। উড়ন্ত টাকাগুলো যারা ধরছে তারা দ্বীপে রাখছে না, ফলে দ্বীপের এই অবস্থারও পরিবর্তন হচ্ছে না।

আরও ঘন্টা দুয়েক পরে। শিপে উঠবো বলে টিম থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ হাতে স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখি – সেই ছেলেটা যার কেবল বিস্কুটের ক্ষুধা! সেন্টমার্টিন্সের মত ছোট্ট দ্বীপে আবারও দেখা হয়ে যাওয়া মোটেই অবাক হওয়ার মত ঘটনা নয়, কিন্তু সে আমাকে পরিচিতের মত হাত আচরণ করবে তেমনটা আশা করি নি। হেসে দিলাম তাকে দেখে? ‘কি! দুই টাকা লাগবে বিস্কুটের জন্য?’ সে হাসে, কিন্তু কথা বলে না। আমি পকেট থেকে যে দুইটাকার নোটটা দিলাম তার এক কোনা কলমের কালিতে কালো হয়ে আছে। অচল নোট বলে সে নোট ফিরিয়ে দিতে চায়। আমি তাকে বোঝাই – দুইটাকার নোটে কোন অচল নাই, কিন্তু সে ঝুঁকি নিতেও রাজী না। আমি একটি দশটাকার নোটের সাথে দুইটাকা মিলিয়ে বারোটাকা দিতে চাই, কিন্তু তাতেও সে দুইটাকা নিতে চায় না – বড় অদ্ভুত ছেলে!

টিমের বাকী সবাই শিপে উঠতে শুরু করেছে, এই ছেলের একটা ছবি ক্যামেরায় নিয়ে নেয়া প্রয়োজন। পকেটে হাত দিয়ে ক্যামেরা বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম – ‘নাম কি তোমার?’

এই প্রথম ছেলেটা প্রশ্নের উত্তর দিল – ‘নাজমুল’! উত্তর শুনে আমি পকেট থেকে হাত বের করে ফেললাম, এই ছবিটা বাদ থাকুক!

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *