মসজিদের ইমাম সাহেব জোহর নামাজের পরে এলাকার বাচ্চাদের ঘন্টাখানেক আরবী পড়ান।আলিফ বা তা ছা। আলিফ লাম মিম, যা লিকাল ক্বিতাবু লারাইবা ফি’হি হুদাল্লিল মুত্তাকিন। দোয়া কুনূত, অযু গোছলের ফরজ ইত্যাদি। একদিন শেখালেন সালাম আদান প্রদানের গুরুত্ব। দিনে কমপক্ষে চল্লিশ সালাম। বড়দের সালাম, ছোটদের সালাম। বন্ধুদের সালাম, আব্বা আম্মাকে সালাম। হুজুরের বাসা থেকে তৌহিদ কামাল বাঁধনের বাসা কয়েক হাত দুরত্বে। হুজুর নির্দেশ দিলেন – বাসায় গিয়ে আব্বা আম্মাকে সালাম দিবি যেন আমি বাসা থেকে শুনতে পাই। আমরা হাসি – আব্বা আম্মাকে কেউ সালাম দেয়?
বাঁধনের কপাল খারাপ – বাসাটা হুজুরের বাসার পাশে। পড়ি তখন প্রাইমারী স্কুলে, বাঁধন আমাদের বন্ধু। হুজুরের ভয়, নাকি বাঁদরামি জানি না – বাঁধন বাসায় ঢুকেই সর্ব্বোচ্চ শক্তিতে “আব্বা আসসালামু আলাইকুম, আম্মা আসসালামু আলাইকুম” বলা শুরু করল। সেই যে শুরু আর শেষ হল না, এর মাঝে আমরা প্রাইমারী থেকে হাই, হাই থেকে কলেজ, কলেজ শেষ করে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অবস্থা, মক্তবে পড়া বন্ধ করেছি সেও পনেরো ষোল বছর – কিন্তু বাঁধনের “আব্বা আসসালামু আলাইকুম, আম্মা আসসালামু আলাইকুম” বন্ধ হয় নাই। শুনেছি, বাঁধন বিয়ে করে সংসারী, জানি না সেই অভ্যাস এখনো আছে কিনা।
ক্লাস এইট বা নাইনে থাকতে বন্ধু নিও হঠাৎ একদিন দেখা হওয়ামাত্রই ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলল। সে কি আগের দিন সালামের গুরুত্ব সম্পর্কে কোন ওয়াজ নসিহত শুনে এসেছে কিনা জানি না, তবে ক্লাসমেট বন্ধুদেরকে যে সালাম দিলে দারুন মজার পরিবেশ তৈরী হয় সেটা বুঝতে মুহুর্ত সময়ও লাগল না। শুরু হয়ে গেল – কে আগে সালাম দিতে পারে! সালামের স্পিরিট বহু দূরে, সাময়িক আনন্দের উদ্দেশ্যে শুরু করা সালামের প্রচলন আর বন্ধ হয় নাই। গত তিনদিন নিও’র বাসায় ছিলাম – সাময়িক সেই আনন্দ বিদায় নিয়েছে, সালামের প্র্যাকটিস এখনো চলছে।
২০০৯ সালের শেষের দিকে সদ্যস্থাপিত এক স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে গেলাম। স্কুলের ডকিউমেন্টারী তৈরীর দায়িত্ব নিয়েছিলাম, এডিটিং শেষে প্রথম কপি দেখাবো। তিনি আমার সামনেই তার স্কুলের এক ম্যাডামকে ফোন দিলেন – ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে কথা বলা শুরু করলেন। প্রথমে বুঝতে পারি নি, কিন্তু পরে বুঝলাম, অপরপ্রান্তের ভদ্রমহিলা আর কেউ নন, তারই স্ত্রী। তাদের কয়েক বছরের দাম্পত্য জীবন – এখন কর্মজীবনও একত্রে। বউকে কেউ সালাম দেয় বা দিতে পারে – আমার জীবনে সে এক আশ্চর্যময় ঘটনা।
চ্যাটিং শুরু করেছি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করার পর। চ্যাটিং ল্যাঙ্গুয়েজ দৈনন্দিন ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে একটু আলাদা – এখানে কথা শুরু করতে হয় ‘হাই’ বলে, রিপ্লাইয়ে বলতে হয় ‘হ্যালো’; আমি পাল্টে দিলাম নিয়ম, শুরু করতে হবে ‘সালাম’ দিয়ে। সালাম, আসসালাম অথবা আসসালামু আলাইকুম। মানুষ এত অধার্মিক হয়ে যায় নি যে সালামের জবাবে ‘সালাম’, ওয়াসসালাম কিংবা ওয়ালাইকুম আসসালাম বলবে না। বলেও না। কেউ ‘হাই’ বলে নক করলে জবাবটা যদি ‘সালাম’ হয়, রিপ্লাইটাও সালাম পাওয়া যায়। মানুষ প্রভাবিত হয়, আমার আগেই সালাম দেয়ার প্রতিযোগিতা আমার বন্ধু তালিকার বেশ কয়েকজনই করেছে। বাম ঘরানার কিছু বন্ধু আছে, এদের কেউ কেউ সালামের জবাবে সালাম দেয় না, শুভেচ্ছা, সুপ্রভাত বা হাসিমুখের ইমো পাঠায় – সালামের জবাব কেন দেয় না সেই ব্যাখ্যা তাদের কাছে, আমি সালাম দেয়া বন্ধ করি নাই। ফলাফল হল, অন্তত: দুইজন পরবর্তীতে আমাকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে নক করেছে।
সালাম শুধু সম্ভাষন নয়, সালাম একটা দোয়া, হাই-হ্যালো-হাসিমুখ সেই দোয়া বহন করে না, সালামের মধ্যে শান্তির জন্য যে শুভকামনা তাও বহন করে না। একটি হাদীস এবং একটি কোরআনের আয়াত দিয়ে শেষ করি।
“আমি কি তোমাদেরকে এমন কথা বলবো না যা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করবে? তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রচলন কর। (সহীহ মুসলিম)
‘যে দিন তারা আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হবেন সে দিনও তাদের অভিবাদন হবে সালাম।’ (সূরা আহজাব: ৪৪)