মোরগের ডাক

চুপচাপ নিস্তব্ধ পরিবেশ। শেষ রাতের হাওয়া ঠান্ডা এনে দিচ্ছে। গাছের পাতায় জমে থাকা রাতের শিশির বিন্দু টুপটাপ করে টিনের চালে পড়ছে। আশপাশ ফর্সা হয়ে গেছে, সূর্য উঠি উঠি করছে। ফজরের নামাজ শেষে আবার ঘুমানোর জন্য শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে ছেলেটা।

একটা পাখি ডাকছে থেমে থেমে। অদ্ভুত তার ডাক – টিউউবব … টিউউব। শহরে বড় হওয়া ছেলেটা নাম জানে না এই পাখিটার, হয়তো কখনো দেখেও নি। সে ঘুমানোর চষ্টা করতে লাগল।
কুককুরু কুউউউ…

মাথার মধ্যে নানারকম চিন্তাভাবনা ঘুরে ফিরে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন। এলোমেলো। এই ঢাকার কথা মনে পড়ছে তো এই আম্মার কথা, এই অফিস কলিগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তো সেই স্কুল বন্ধু। বাসার বেড়ালটার কথাও মনে পড়ে গেল, সাথে সাথে মনে পড়ল কোয়েল পাখিগুলোর কথা, আর খরগোস।
কুককুরু কুউউউ…

পাশের বাড়ির জামাল সাহেবের মোরগটা ডাকছে। মোরগটা বিশাল। গলায় পশম নাই, লাল টকটকে ঝুটি – টার্কির কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রচন্ড রকম পুরুষ হাটা চলায় আচার আচরনে। সূর্য উঠার আগেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
কুককুরু কুউউউ…

মোরগের ডাকের সাথে বাচ্চাবেলার কথা মনে পড়ে গেল তার। একটা ছবির বই ছিল তার – চীন না রুশ দেশের
রূপকথা। মোরগের সাথে বেড়ালের শত্রুতা কিভাবে তৈরী হল তার গল্প। মোরগ বলত তার মাথার লাল আগুন-রঙা ঝুটিতে আগুন আছে। বেড়ালরা তার কথামত না চললে সেই আগুনে পুড়িয়ে দেবে সব কিছু। একদিন বেড়ালের বাসার আগুন গেল নিভে। বেড়াল ছানা তাই গেল মোরগের কাছ থেকে আগুন চাইতে। ঘুমন্ত মোরগের ঝুটি থেকে চুপি চুপি আগুন ধরিয়ে নিতে চেয়েছিল বেড়াল ছানা। কিন্তু আগুন ধরল না। বেড়াল মা এসে ধরে দেখল আগুনের ঝুটি। ঠান্ডা! মিথ্যে কথা! প্রতারণা! মোরগ হয়ে গেল বেড়ালের শত্রু।
কুককুরু কুউউউ…

কতবার পড়া হয়েছিল এই বইটা? কতবার? একশবার? দুইশবার? পাচশবার? একহাজার? হতে পারে। জামাল সাহেবের মোরগটা ছবির বইয়ের সেই মোরগটার মত কি? সে কি বাড়ির বাউন্ডারি দেয়ালের উঠে তারপর ডাকছে? মোরগের ডাকে একটা ছন্দ টের পাওয়া যাচ্ছে না? ছেলেটা গুনতে শুরু করল – এক … দুই … তিন … চার… পাঁচ …
কুককুরু কুউউউ…

আবার – এক … দুই… তিন… চার…পাঁচ…ছয়…সাত…আট…নয়…দশ…এগারো…বারো…তেরো…চোদ্দ…পনেরো
কুককুরু কুউউউ…

পনেরো সেকেন্ড। চার…পাঁচ…ছয়…সাত…আট…নয়…দশ…এগারো…বারো…তেরো…চোদ্দ…পনেরো
কুককুরু কুউউউ…

অদ্ভুত! পনেরো সেকেন্ড পর পর ডাকছে মোরগটা। সকালে মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙ্গার কথা অনেক পুরানো। তবে কি মোরগের কাছে আছে কোন ঘড়ি? কোনদেশী ঘড়ি সেটা? চায়না? বাংলাদেশ? নাকি সুইস ওয়াচ?
কুককুরু কুউউউ…

এবার একটু দেরী করে ডাকলো? গুনলে আঠারো পর্যন্ত হয়ে যেত না? ডাকটাও একটু আস্তে মনে হল। মোরগটা কি তবে দেয়াল থেকে নেমে গেল?
কুককুরু কুউউউ…

হুম। অনেক আস্তে শোনা গেল এবারের ডাক। এবার বিশ সেকেন্ড পরে। তারমানে মোরগটা আর এদিকে নেই। চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও। অন্য কারও বাড়ির সামনে গিয়ে ডাকবে বোধহয়। ওখানে দাড়িয়ে কি সে পনেরো সেকেন্ড বিরতিতে ডাকবে? কুককুরু কুউউউ… কুককুরু কুউউউ…

ছেলেটার চোখ বন্ধ হয়ে এল।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *