বৃষ্টিভেজা সিলেট

‘বিশ মিনিটে যেতে পারবেন কমলাপুর?’
‘জ্যাম না থাকলে পারবো না ক্যান?’
‘কত নিবেন?’
‘সত্তর’
‘চলেন’ – শাহবাগ থেকে কমলাপুরে রিকশায় বিশ মিনিটে যাওয়া সম্ভব এবং সেটা বৃহস্পতিবার রাত সোয়া নটার পরে, সেটা আমার বিশ্বাস হয় না, কিন্তু আমার আর কোন উপায়ও ছিল না। বাসা থেকে বের হয়েছি নটা পনেরোয়। বাসে উঠেও মিনিট দুয়েক পরে নেমে গেলাম – কারণ বাস কার্যত: স্থবির। ছেলেরা বলেছে ৯টা ৪০শে ট্রেন এবং এই ট্রেন একটুও দেরী করে না, তারা সাড়ে আটটার দিকেই স্টেশনে বসে আছে, কয়েকবার ফোনও করে ফেলেছে আমাকে – সুতরাং টেনশন থেকে বেচে থাকা আমার জন্য সহজ ছিল না। আমি টেনশন থেকে মুক্ত থাকার জন্য মোবাইলে মেসেজ লিখতে থাকলাম। দুই দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি, অনেকগুলো ইন্সট্রাকশন দিয়ে যেতে হবে – নচেৎ গন্ডগোল বেধে যাবার আশংকা আছে।
রিকশার পাইলট আমাকে বিশ নয়, তেইশ মিনিটে রেলস্টেশনে নিয়ে এলেন। অবশ্য ততক্ষনে ঘড়িতে ৯টা ৪৩ বাজে। রিকশা থেকে নেমেই দৌড়। দৌড় দৌড় দৌড়। প্লাটফর্মে পৌছে থামলাম। ট্রেন দেখা যাচ্ছে। স্থবির। ছাড়লেও দৌড়ে উঠে যাওয়া যাবে। ছেলেরা অপেক্ষা করছিল। ২০১১-তে বান্দরবান ভ্রমণে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম ৭ জনকে। তাদেরই ৪ জন এবার আমাকে নিয়ে যাচ্ছে সিলেট। আয়োজন ব্যবস্থাপনা তাদের, আমি শুধু ঘুরবো। ট্রেন ছাড়ল। ট্রেন ইঞ্জিনের ঠিক পেছনে গার্ড কম্পার্টমেন্টের ফ্লোরে গাদাগাদি করে আমরা পাচজন রাত কাটানোর ব্যবস্থা করলাম, একজন শোয়া, দুইজন আধশোয়া, একজন চেয়ারে বসে, অন্যজন ফ্লোরে বসে। মিয়ানমারের শরণার্থীদের কথা মনে পড়ে গেল। টিকেট না পাওয়ায় ৫জনের ব্যবস্থা হয়েছে ৭০০ টাকায়। গরীবের ঘোড়া রোগ, সীমিত টাকা পয়সা, কিন্তু পেটভর্তি ভ্রমণক্ষুধা।
বিনা টিকিটের যাত্রীরা প্লাটফর্ম দিয়ে বের হতে পারে না, তাদের জন্য উল্টোদিকে লোহার বেড়ায় ভাংগা আছে। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে, আমরা ৫জন সেই ভাংগা জায়গা দিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। একটা টেম্পুতে চলে গেলাম শাহজালাল (র) এর মাজারে। এখানে বাথরুম পাওয়া যাবে নিশ্চিত, সুতরাং ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে তারপর শুরু হবে সিলেট ভ্রমণ। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। আমরা টেম্পুতে বসে ছাদের ফুটোর পানি থেকে নিজেকে আড়াল করছি। ক্বীন ব্রিজ পার হয়ে টেম্পু ছুটে চলল মাজারের দিকে।
মাজার এলাকায় ছবি তোলা যায়, বাধা দেয়ার কেউ নাই। বাহিরের প্রাঙ্গনে সবাই ছবি তুলছে, ঘড়িতে বাজছে ছটা। অথচ প্রচুর দর্শনার্থী। বেশীরভাগই দরিদ্র শ্রেনীর। এরা মাজারে এসেছে বিভিন্ন মান্নত নিয়ে, অনেকর হাতেই বিভিন্ন রং এর সুতা, কারও হাতে আগরবাতি, কেউ নগদ অর্থ দিচ্ছে মাজারে খাদেমের হাতে, মহিলারা তাদের জন্য নির্দিষ্ট রুমে গিয়ে ঢুকছে, উড়ন্ত পর্দার ফাক দিয়ে দেখা যায় কেউ সেজদা করছে, কেউ হাজরে আসওয়াদের মত দেয়ালে চুমু খাচ্ছে। খোলা জায়গায় কান্নাকাটি করছে কিছু নারী, বিচ্ছিন্নভাবে। এদের অন্তরে বোধহয় অনেক কষ্ট। সমাধানের জন্য এসেছে হযরতে মাজারে, আশা করে বসে আছে শত বছর আগে যে মানুষটি মারা গিযেছেন, তার উছিলায় তার সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বিশাল বিশাল গজার মাছকে খাবার দিচ্ছে অনেক মানুষ। তিনজন খাদেম ভক্তদের থেকে নজরানা নিচ্ছেন। নগদ টাকা, মোমবাতি, আগরবাতি, মিষ্টান্ন। আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম এইখানে দৈনিক কত টাকা নগদ আয় হয়। দশটাকার নিচে কেউ-ই দান করছে না, খাদেমরাও দান গ্রহণ থেকে বিশ্রাম নিচ্ছেন না। দৈনিক কি এক লাখ টাকা নগদ পাওয়া যায় এখানে? আমার মনে হল – নগদ না হলেও সব মিলিয়ে লাখ টাকার কম হওয়ার কথা না।
পেছনে কবরস্থান। সবাই দেখতে যাচ্ছে, আমরা দুজন গেলাম। বাকীরা পরে যাবে। আমার উদ্দেশ্য সালমান শাহ’র কবরখানা দেখে আসা। সেই বাচ্চাকালে যখন এসেছিলাম তখন সালমান শাহ সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি কাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এবার তিনি কব্বরে। ছবি তুললাম লুকিয়ে। কোথাও নিষেধাজ্ঞা নাই, কিন্তু সতর্ক থাকা ভালো। মাজারের ছবি তোলা, কবরের ছবি তোলা নিয়ে অনেকে প্রতিবাদ করেন। মাজারে বাথরুম জায়গা পাওয়া গেল না। প্রচন্ড ভীড়, সুতরাং আমরা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম।
জাফলঙ পর্যন্ত বাস যায়। বাসে যখন উঠলাম তখন জোর বৃষ্টি হচ্ছে, এই বৃষ্টিতে ঢাকা শহরে পানি জমে যাবে, কিন্তু পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় সিলেটে কোথাও পানি জমছে না। অসাধারণ এক বাসভ্রমন জাফলং পর্যন্ত। শহরে পেরোতেই দুই ধারে বিল এলাকা শুরু হল। যেদিকে চোখ যায় পানি আর পানি। আর এর মাঝে একটি রাস্তা, সোজা মিশেছে অসীমে। সেই রাস্তা দিয়ে আমরা ছুটে চলছি। ঝুম বৃষ্টি। অসাধারণ। বর্ষাকাল ছাড়া এমন দৃশ্য আর কে কবে দেখবে?
বিল এলাকা শেষ হতে না হতেই দূরের পাহাড়গুলো দুম করে কাছে চলে এল। কাছে মানে দৃষ্টিসীমানার মধ্যে। আর আমরা দেখলাম- ওই পাহাড়ে ছোট ছোট অনেক ঝর্না। কটা ঝর্ণা দেখলাম? দশটা? পনেরোটা? হবে বোধহয়। সা সা করে বাস ছুটে চলছে। বাসে পর্যটক বলতে আমরা পাচজনই। দূরের ঐ ঝর্নাগুলো আমাদের চোখে বিরাট আকর্ষন, বাকিরা নিরাসক্ত। কেউ তাকিয়েও দেখছে না। ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। অসম্ভব – এই ক্যামেরার যোগ্যতা নেই। তারপর দেখা গেল বড় আকারের ঝর্ণাগুলো। দুটো। পাহাড়ের একদম চূড়া থেকে আছড়ে পড়ছে নিচে। আমাদের থেকে সেই ঝর্ণার দুরত্ব ৪/৫ কিলোমিটার এর কম হবে না বোধকরি। কিন্তু কি জীবন্ত সেই ঝর্ণা, সামনে কিরকম বিশাল ঝর্না হবে সেই কল্পনায় আমার কান্না পেয়ে গেল। এইরকম একটা ঝর্না আমাদের হতে পারতো। হল না কারণ ১৯৪৭ এ মাথামোটা জিন্নাহর কারণে। মুসলমানদের জন্য একটি দেশ হবে – এই আনন্দে বগল বাজাতে গিয়ে পাহাড়ের মত প্রাকৃতিক সম্পদগুলো দিয়ে দিল ভারতকে। চিটাগং হিলট্রাক্টস না থাকলে এই পাহাড় দেখতেই আমাদের ভারতে যেতে হত।
সীমান্তের ওপারে কি বিশাল আর যৌবনোদীপ্ত দুটো ঝর্ণা – আফসোস আর আফসোস :(
জাফলং পর্যন্ত বাস গেল না, রাস্তা ভাংগা বলে এক জায়গায় নামিয়ে দিল। বাকীটা অটোতে। বৃষ্টির বেগ কমেছে, তবে ভিজিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট, থামিয়ে দেয়ার জন্য নয়। পায়ে হেটে জাফলং- এ নদীর তীরে পৌছে গেলাম। ছবির জাফলং এর সাথে কোনই মিল নেই। ছবিতে জাফলং বলতে দেখা যায় অল্প পানিতে পাথর মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে, বালিয়ারিও দেখা যায়। এখন থই থই পানি। ওই দূরে পাহাড় দেখা যায়, বৃষ্টিতে সব ঝাপসা। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, আমরা একটা দোকানের নিচে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই অনেক ভ্রমনপিপাসুকে দেখা যাচ্ছে, একসময় আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। মাহাদী একটা নৌকা ভাড়া করার চেষ্টা করেছিল। দূরে একটা স্পট আছে, সেখান থেকে আসামের রাস্তা দেখা যায়, দেখা যায় একটা ঝুলন্ত সেতু। সেখানে আছে একটা টিলা। নৌকার রিজার্ভ ভাড়া চায় ৫০০ টাকা। আমাদের পোষায় না, সুতরাং বৃষ্টিতে ভিজে পায়ে হেটে আমরা এগোতে লাগলাম। ইতোমধ্যে ব্যাগ থেকে গামছা বের করে ঘোমটা দিয়েছি আমি। বেশ কিছুদূর যাবার পরে পাওয়া গেল আরেক বোটম্যানকে। তিনি জনপ্রতি ২৫টাকা ভাড়া চাইলেন। সাধু সাধু। এত সস্তায় যাওয়া যায়? অথচ সেই বোটম্যান তার ভোতা দা দিয়ে আমাদের জবাই করার চেষ্টা করছিলেন। আমরা নৌকায় উঠে পড়লাম।
শীতকালের জাফলং (কৃতজ্ঞতা: গুগুল)
শীতকালের জাফলং (কৃতজ্ঞতা: গুগুল)
বর্ষায় জাফলং
জাফলং ভ্রমন শেষ, অথচ বৃষ্টির কমতি হচ্ছে না। খুজ করে জানা গেল, একটা দোকানে পলিথিন পাওয়া যাবে। গজ ত্রিশ টাকা। জন প্রতি একগজ হিসেবে পাচ গজ কিনে নিলাম। নি:সংকোচে নীল রং-এর পলিথিনে শরীর ঢাকলাম।
যে কোন জায়গায় ভ্রমনের আগে তার সম্পর্কে ধারনা নিয় যেতে হয়। অন্তত: এই ক্ষেত্রে আমি কোন ভুল করি না। কিন্তু সিলেট ভ্রমনের ক্ষেত্রে আমি ব্যতিক্রম। যেহেতু আমি অনেকটা গেস্ট, তাই কোন কোন স্পটে ঘোরা হবে তার দায়িত্ব মাহাদীর উপরই। বেচারা ঢাকায় অনলাইন ঘেটে অনেক পড়াশোনা করে এসেছে, কিন্তু শেষ মুহুর্তে প্রিন্টআউট নেয়ার সুযোগ পায় নি। ফলে, জ্যাক-এর মোবাইলের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। তামাবিল সীমান্তে দেখার তেমন কিছু নেই, কিন্তু তাও আমরা থামতে চাই।

এইটা ফাও – সীমান্ত এমন কিছু না, কিন্তু এই সীমান্ত পিলারের গায়ে দারাশিকো ডট কম লেখা। এইজন্য তুললাম :)

এবার যাবো জৈন্তাপুর। জৈন্তাপুরের প্রতিই আমার সবচে আগ্রহ। কারণ উইকি থেকে জ্যাক জানিয়েছে, এখানে আছে মেগালিথিক মনুমেন্টস ( megalithic monuments)। মেগালিথিক শব্দের শাব্দিক অর্থ জানা যাচ্ছে না, তবে যানা গেল, পাথরের তৈরী স্থাপনা আছে এখানে। এই বৃষ্টির মাঝেও আমি সেই পুরানো বাড়ি-দালান-প্রাসাদের গন্ধ পেলাম যেন। শত শত বছরের পুরোনো এক সভ্যতায় ফিরছি যেন।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *