সোমেশ্বরী নদীতে

নদী আমার খুব অপরিচিত না। বাচ্চাকাল থেকেই নদীতে ভ্রমনের বেশ অভিজ্ঞতা আছে, এই অভিজ্ঞতা আনন্দের কখনো কখনো ভয়েরও। আমার বড় ভাই একবার পল্টুন থেকে নৌকায় উঠার ঠিক আগ মুহূর্তে নৌকাটা সরে যাওয়া নদীতে পরে গিয়েছিল। তখন আমি ছোট – বোধহয় স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি মাত্র। সাতার না জানা বড় ভাইকে উদ্ধারে তখন মাঝি ঝাপ দিয়ে নদীতে পড়েছিল। তেমন কিছুই হয়নি – দু-এক ঢোক পানি খাওয়া ছাড়া। তবে ঘটনাটা এই মূহুর্তে যত সহজে বলে ফেলা যাচ্ছে, ঠিক ততটা সহজ বোধহয় ছিল না – বিশেষ করে আব্বা-আম্মার কাছে। বর্তমানে এই ঘটনা ভাবলে আমি বুঝতে পারি, তাদের জায়গায় আমি থাকলে ঠিক সেই মুহূর্তে হার্ট অ্যাটাক করাটা খুব অসম্ভব কিছু হতো না।

ভয়ানক অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করলেও নদী আমার বেশ ভালোই লাগে, ভয় লাগে না। সাতার জানি না বলে কখনোই নদীতে নামতে আপত্তি করি নি। ছোটবেলায় বিশাল বিশাল নদী দেখেছি, এক পাড় থেকে অন্য পাড় দেখা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘোরাঘুির তাতে এমন কোন নদী চোখে পড়ে নাই। তবে এই সব নদীর কোনটিই সোমেশ্বরী নদীর ধারে কাছেও যেতে পারে না।

সোমেশ্বরী নদী

চিনামাটির পাহাড়ে যাবার সময়ই সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে যেতে হয়েছিল। এমন একটা নদী যা দূর থেকে দেখেই মনকে শান্তি দিয়েছিল। নদী পা হওয়ার জন্য ইঞ্জিনচালিত খেয়া আছে। সেই খেয়ায় করে পার হয়েছি নদী। ছোট্ট নদী, ওপারে নামার পরে বেশ অনেকটা দূর চকচকে বালির উপর হেটে রাস্তায় উঠতে হয়। তারপর পায়ে হেটে অথবা রিকশায় অথবা মোটরবাইকে চীনামাটির পাহাড়। চীনামাটির পাহাড়ে সবাই যখন গাছের নিচে আনন্দে মশগুল তখন আমরা তিনজন বেশ দূরে পাহাড়ের ছায়ায় বসে সিদ্ধান্ত নিলাম ফেরার সময় নদীতে নামবো। সোমেশ্বরীতে অবগাহন না করাটা অন্যায় হয়ে যাবে।

নেত্রকোনা ভ্রমণে গিয়েছিলাম আবারও। এই ভ্রমণ আর সেই ভ্রমণ মিলিয়ে লিখেছিলাম আরেকটি লেখায়।
পড়তে পারেন এখানে

গ্রুপেরও প্ল্যান আছে নদীতে গোছল করার, কিন্তু সেটা আজ নয়, আগামীকাল ভোরে। অত সকালে নদীতে গোছল করার কোন মজাই পাওয়া যাবে না। তারচে কড়া রোদে হেটে গিয়ে নদীর পানিতে গা ডুবিয়ে বসে থাকবো সে দারুন অভিজ্ঞতা হবে। এই চিন্তা থেকেই সকালে সবাই যখন রেস্টহাউজ থেকে খালিহাতে বের হচ্ছে আমি তখন একটা লুঙ্গি ব্যাগে নিয়েছি। অবশ্য সেই লুঙ্গি আমার হাতে নেই এখন। মাঝরাস্তায় আমাদেরই এক সদস্য তার প্রয়োজনে নিয়েছে এবং চীনামাটির পাহাড়ে পৌছুবার পরে আমােদর আরেক সদস্য গাছে চড়তে গিয়ে প্যান্ট ছিড়ে ফেলার পর আমার লুঙ্গি তার গায়ে। ফলাফল, যেই সেই।

সোমেশ্বরী নদীর নামকরণ নিয়ে একটা ছোট্ট রিপোর্ট পাওয়া গেল সমকাল পত্রিকায়। গুরুত্বপূর্ণ, তাই পুরোটাই কপি পেস্ট করলাম।

অনেক অনেক দিন আগের কথা। উত্তরের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা এক নদীর নাম ছিল ‘সমসাঙ্গ’ [সোমেশ্বরী নদীর আগের নাম]। ওই নদীর তীরে ধীবররা বসবাস করত। তাদের বলা হতো ‘পাটুনি’। তখন ওই অঞ্চল শাসন করত গারো সম্প্রদায়ের এক দলপতি, যার নাম বাইশা গারো। বিভিন্ন কারণে বাইশা গারোর ওপর ধীবররা সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু শক্তি সাহস কম বলে তাকে মেনে নিতে বাধ্য ছিল। ১২৮০ খ্রিস্টাব্দে সোমেশ্বর পাঠক কামরূপ কামাখ্যা ইত্যাদি তীর্থ দর্শন শেষে গারো পাহাড়ে আসেন। ওই সময় গারো পাহাড় ও তার আশপাশের এলাকা ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা। নানা প্রজাতির পশুপাখির কলকাকলিতে সারাক্ষণ এলাকাটি মুখর থাকত। এখানকার সৌন্দর্য আর সুমসাং নদী তীরের নীরবতা সোমেশ্বর পাঠককে মুগ্ধ করে। তার মনে বিশ্বাস জন্মে, সিদ্ধিলাভের জন্য এ স্থানটিই উত্তম। সোমেশ্বর তার অনুচরদের নিয়ে সেখানেই আস্তানা গাড়েন।

ক্রমে যোগাযোগ গড়ে ওঠে ওই এলাকার জেলেদের সঙ্গে। সোমেশ্বর ছিলেন অসামান্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ। ধীবররা তাকে দেবতা এবং ত্রাতা মনে করতে থাকে। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দুর্গাপুর [বর্তমান নেত্রকোনা জেলায়] গ্রাম। সোমেশ্বর পাঠক সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রহ। সোমেশ্বর তার আগের বাসস্থান কান্যকুব্জ থেকে স্বজনদের নিয়ে এসে বসতি গড়েন সেখানে। এতে তার শক্তি আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। এক সময় সুযোগ বুঝে ওই এলাকার অত্যাচারী শাসনকর্তা বাইশা গারোকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুসং রাজ্য’। এরপর তিনি নজর দেন রাজ্যের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে।

ওই এলাকার ধীবররা সোমেশ্বর পাঠককে সাক্ষাৎ দেবতা মনে করত। তারা ভাবত, জেলেদের উন্নতির জন্যই সোমেশ্বর ঠাকুর নিজ হাতে সুসং রাজ্য গড়েছেন। তারা এও মনে করত, সুসংয়ের মানুষের পানিকষ্ট দূর করতেই প্রভু সোমেশ্বর নিজ হাতের ‘ভৃঙ্গার’ থেকে পানি ঢেলে দেওয়ায় সেখান থেকে সৃষ্টি হয় সোমেশ্বরী নদী। তবে অনেকেরই ধারণা, উত্তর পাহাড়ের ঝর্ণাধারা ‘সমসাং’ বয়ে যেত ওই এলাকার ভেতর দিয়ে। সে ঝর্ণাধারার গতিপথ পরিবর্তন করে সোমেশ্বর পাঠক তা নিয়ে এসেছিলেন সুসংয়ের রাজধানী দুর্গাপুরের কাছে। এ কারণেই ওই নদীর নাম হয় সোমেশ্বরী নদী।

প্যান্ট পাল্টে সৈনিকের লুঙ্গি পরে তারপর নদীর তীরেই প্যান্ট শার্ট মোবাইল মানিব্যাগ, মোবাইল, ক্যামেরা ইত্যাদি রেখে নেমে পড়লাম নদীতে। শান্তি শান্তি। ঠান্ডা পানি। গা শিরশির করে। পায়ের নিচে বালু। হালকা স্রোত টের পাওয়া যাচ্ছে। সেই স্রোতে পায়ের নিচের বালু সরে যাচ্ছে। সীবিচে এই অভিজ্ঞতাটুকু পাওয়া যায়। সোমেশ্বরী নদী বেশী চওড়া নয়, সবচেয়ে সংকীর্ন জায়গাটুকু হয়তো দেড়শ-দুশো ফিট। পানি নেই বললেই চলে। বিস্তীর্ণ চর। তার উপর ঝা চকচকে বালু। দূরে ভারতের পাহাড় দেখা যায়। বাতাসে লুঙ্গি উড়ে যেতে চায়।

সোমেশ্বরী নদীর গোড়ালী পানিতে দাড়িয়ে কিছুক্ষন হাটাহাটি করলাম। তারপর বসে পড়লাম। বসলে মনে হয় বুক সমান পানিতে বসেছি। আসলে পানি হাটুর নিচে। সৈনিকের লুঙ্গি আমার কাছে বলে সে গামছা পেচিয়ে নেমেছে। সাকিব কিছুই না – প্যান্ট পড়েই। রেস্টহাউজে তার এক্সট্রা প্যান্ট আছে, সুতরাঙ ভেজাতে সমস্যা নেই।

বাকীরা নদীর তীরে আসতে আসতে কমে আধাঘন্টা লাগল। এই সময়টায় আমরা তিনজনে পানিতে ছোটাছুটি করলাম। যারা সাতার জানে তারা বুক পানিতে সাতার দেয়ার চেষ্টা করল। আমি বসে থেকে দেখলাম। তারপর তিনজনে ধীরে ধীরে একটু ঘুরে নদীটা হেটেই পার হয়ে গেলাম। সর্বোচ্চ পানি বুক সমান। ওখানে একটু ভয় লাগে। পানির স্রোত বুকে অনুভব করা যায়। সাতার জানি না বলে জানি যে পানিতে ডুবার পরে প্রথম কাজটিই হল এক ঢোক পানি খাওয়া। এই অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। সুতরাং এই পানিতে ডুবে মরবো না জেনেও পানি খাওয়ার ভয়ে হাত ধরে নদী পার হলাম। তারপর ভেজা গায়ে নদীর তীরে উঠে কাপড় পাল্টানো। ক্যামেরা এবং মোবাইলে পানি ঢুকলো কিনা সেইটা নিশ্চিত করলাম।

পানির সাথে আমার মোবাইল এবং ক্যামেরার বেশ ভালো সম্পর্ক। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে প্রথম ক্যামেরাটা কেনার তিনদিনের মধ্যে ক্যামেরাটা নষ্ট হয়েছিল, একই ঘটনায় দেড় মাস আগের কেনা মোবাইলটাও। সেন্ট মার্টিনে গিয়ে ক্যামেরা অন্যদের হাতে দেয়া হলেও মোবাইল পকেটে নিয়ে পানিতে ঘুরে বেড়িয়েছি বেশ কিছু সময়। পটুয়াখালীর দুমকিতে রাত নৌকায় করে নদীতে বেড়াতে যাবার সময় সাথের বড় ভাই তার মোবাইলটি নিরাপত্তার জন্য আমার হাতে দিয়েছিলেন। নিজের মোবাইলটি ঠিক আছে কিনা চেক করতে গিয়ে তার মোবাইলটি ফেলে দিয়েছিলাম নদীতে। সুতরাং সাধু সাবধান।

দুই দিনের এই ভ্রমনে সোমেশ্বরী নদীর তীরে এসেছি আরও তিনবার। রাতে সবাই মিলে ক্যাম্পফায়ার করতে এলাম সোমেশ্বরী নদীর তীরেই। সবাই যখন হইচইয়ে মত্ত, তখন আমি মাথার উপর বিশাল একটা চাদ নিয়ে একাকী ঘুরে বেড়িয়েছি নদীর তীর ধরে, মাঝে মাঝে বালির তৈরী পাড় ভেঙ্গেছি আলতো চাপে। যেই নদীতে এত দুদ্দার করে দাপিয়ে বেড়িয়েছ দুপুরে বেলা সেই নদীই রাতের বেলা কেমন ভয়াবহ রুপ গ্রহণ করেেছ – শিরশিরে অনুভূতি হয়।

পরের দিন সক্কাল বেলায় সোমেশ্বরী নদীর উপরে সেতুতে দাড়িয়ে আবার দেখেছি সোমেশ্বরীর সৌন্দর্য। দুপুরে সবাই মিলে আবার সেই নদীতে গোসল, হৈ হুল্লোর, বুক সমান পানিতে হেটে বেড়ানো আর প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ধন্যবাদ দেয়া। তারা জানে অল্প স্বচ্ছ পানিতে বেড়ানোর কি আনন্দ। আর আমরা যেন সেই আনন্দ পুরোমাত্রায় উপভোগ করতে পারি তাই আমাদের নদীগুলোকে এই আকৃতি প্রদানে তাদের যত আগ্রহ। চমৎকার।

স্বচ্ছ পানির নিচে ঝকঝকে বালির উপরে হেটে বেড়ানোর এই অভিজ্ঞতা আমি কোনদিনও ভুলবো না।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *