প্রথম ছবি তোলা
‘৯০ সালের কথা।
মামাতো-খালাতো ভাইবোনরা মিলে বেড়াতে গিয়েছি, ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে, ছোট মামার সাথে। একটু পর পরই মামা সবাইকে একত্র করে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছেন। একটা গ্রুপ ছবি তোলার সময় ফ্লাশটা বোধহয় একটু বেশীই চমকালো, ছবি তোলা শেষ হলে তাই হাসিমুখে মামাকে বললাম, ‘সূর্যের মতো লাগে’! মামা ভাইবোন সবাইকে সরিয়ে দিয়ে নদীর তীরে একটা সিমেন্টের তৈরী বেঞ্চিতে আমাকে বসিয়ে বললেন, ‘আবার বলতো মামা..’ আমি বললাম, ‘সূর্যের মতো…’ মামা ক্লিক শব্দে ছবি তুললেন। গোল করা ঠোটের সেই ছবিটা একটা ইতিহাস হয়ে গেল, অন্তত: আমার কাছে… কারণ বয়সটা আমার সবে পাঁচ আর এই প্রথম আমার ছবি তোলা হল।
ক্যামেরার প্রতি আগ্রহ
মেজো ভাই প্রথম তার ক্যামেরাটা কিনেছিলেন ২০০০ টাকা দিয়ে, খুবই সাধারণ একটা ক্যামেরা। তাই দিয়েই বোধহয় প্রথম ছবিটা তুলেছিলাম, মনে নেই। তবে মনে আছে ক্যামেরা যে একটি অসাধারণ বস্তু এবং তা দিয়ে অসামান্য সব কাজ করা যায়, সেটা বুঝতে আমাকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত আসতে হয়েছিল। কারণ এখানেই প্রথম ফটোগ্রাফির এক্সিবিশনে গিয়েছিলাম এবং জেনেছিলাম এক একটা ছবি এক একটা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে পারে।
এই আগ্রহটা আরো জোরদার হল যখন সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম, দেখা নয় বরং পেছনের কাজের প্রতি আগ্রহ তৈরী হল। কারণ এখানেই বুঝতে পারলাম ক্যামেরার ফ্রেম এবং লাইট হলো সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, এখানেই তৈরী হয় একটা সিনেমার সবচে’ বড় অংশ।
যতই পড়তে লাগলাম, ততই জানতে পারলাম আর ক্যামেরার আগ্রহটা বাড়তে লাগল পাল্লা দিয়ে। একসময় সিনেমা বাদ দিয়ে ফটোগ্রাফির বই পড়া শুরু করলাম। ছোট মামার কাছ থেকে ধার নিয়ে এলাম এম এ বেগ এর আধুনিক ফটোগ্রাফি বইটা। আগাগোড়া পরে ফেললাম, অনেক কিছুই বুঝলাম না, কারন আমার একটা ক্যামেরা নেই। ব্যাস, কার ক্যামেরা আছে তা জানার চেষ্টা করলাম, সবার কাছে ডিজিটাল ক্যামেরা, অথচ আমার অর্জিত জ্ঞান ফিল্ম ক্যামেরার। তাছাড়া আমি শিখেছি এসএলআর ক্যামেরার বিষয়ে অথচ ডিজিটাল ক্যামেরাগুলোতে একটা রিং ও নেই, তবে ঘুরিয়ে ঠিক করবোটা কি?
একটা ক্যামেরার খোজ পাওয়া গেল, বন্ধু সৌরভের কাছে, এসএলআর। গেলাম তার কাছে। সে তার পুরোনো ক্যামেরাটা বের করে দেখালো এর ফাংশনগুলো, প্রতিটি পার্টস আলাদা করে করে। পুরোনো হওয়ায় লাইট মিটার সঠিক কাজ করে না, আন্দাজে কাজ করতে হয়। ধার চাইলাম ক্যামেরাটা, সে রাজিও হলো, পিছিয়ে এলাম আমি। মাসে যে কটা টাকা কামাই করি তা দিয়ে মাস চলতে কষ্ট হয়, ক্যামেরার মতো হাতি পুষবো কেমন করে? কি আর করা, ফিল্ম ছাড়াই ছবি তুলি, রিং ঘুরাই, ফোকাস ঠিক করি, জুম ইন-আউট করি, এফস্টপ বাড়াই কমাই। কিন্তু ছবি তুলি না … খরচটা বড্ড বেশী।
ফিল্ম নয়, ডিজিটাল
সুতরাং সিদ্ধান্তে এলাম, ফিল্ম ক্যামেরা নয় বরং ডিজিটালই কিনবো। সে এসএলআর হোক আর পয়েন্ট এন্ড শ্যুট। টাকা জমাট বাধে না, যে হারে জমছে তাতে মনে হচ্ছে পাঁচ-ছ বছর লেগে যাবে সবচে’ কম দামের ডিজিটাল ক্যামেরাটা কেনার জন্য… দামটাও কম না, কমপক্ষে চৌদ্দ হাজার টাকা। আশায় বুক বাঁধি, একদিন কোন একভাবে হঠাৎ কিছু টাকা পেয়ে যাবো নিশ্চিত, তখন আর দেরী নয় কিনে ফেলবো একটা ক্যামেরা। তারপর আমায় আর পায় কে? সারা দুনিয়াটা ভরে ফেলবো ছোট্ট ক্যামেরাতে!
এদিকে কিভাবে যেন বন্ধু বান্ধবরা জেনে ফেলল আমার ক্যামেরা এবং ফটোগ্রাফির আগ্রহের কথা। ব্যস, আমি হয়ে গেলাম ফটোগ্রাফার। সকল পার্টি আর পোগ্রামে অবধারিতভাবে ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব পড়ে আমার উপরে। আমিও সানন্দে এগিয়ে যাই, সাধারণ ডিজিটাল ক্যামেরাটা দুইহাতে ডিএসএলআর ক্যামেরার মতো করে ধরি, এক হাত লেন্সের নিচে, অন্যহাত শাটারে, তারপরে ছবি তুলি ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে… ফটোগ্রাফাররা তো আর ডিজিটাল ডিসপ্লে দেখে ছবি তোলে না!
কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়, যতই ছবি তুলতে লাগলাম, ততই পর্দায় আসা কমতে লাগল। আমি ছবি তুলি, আমার ছবি কেউ তুলে না। দেখা যায়, একটা প্রোগ্রামের সব ছবিই আমার তোলা কিন্তু আমার কোন ছবিই নাই.. আমি যে ছিলাম তার কোন অস্তিত্বই কোথাও নাই!!
ফেসবুকে প্রোফাইলে লিখলাম… হবি: ফটোগ্রাফি বাট আই ডোন্ট হ্যাভ এনি ক্যামেরা…। আমার অফিসের বস একদিন সেটা দেখে ফেললেন এবং আমাকে দেখিয়ে তার সিনিয়র একজনকে জানালেন… “এই ছেলেটা তার প্রোফাইলে লিখেছে ‘…. …. …’ পাগল ছেলে, ক্যামেরা একদিন হবে।” আমি লজ্জিত হাসি দিই.. হবেই তো, আমি তো আর হাল ছাড়ি নি।
প্রথম ক্যামেরা কেনা
একদিন হঠাৎ করে একটা কাজ পেয়ে গেলাম, আমার প্রথম ডিরেকশন, প্রথম ডকুমেন্টারী। একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের জন্য আধাঘন্টার একটা প্রমোশনাল ডকু বানিয়ে দিতে হবে, কাঁচা হাতে কাজটা করলাম। এবং বুঝলাম, এত কম বাজেটে গাধাও কাজ করে না। কারন কাজটা করতে গিয়ে আমার পারিশ্রমিক বাবদ ধরে নেয়া টাকাটাও খরচ হবার উপক্রম হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হাজার পাঁচেক টাকা থাকলো। আগের জমানো টাকার সাথে মিলিয়ে দশ হাজার টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম একটা পয়েন্ট অ্যান্ড শূট ডিজিটাল কোডাক ক্যামেরা, ১০.১ মেগাপিক্সেলের, বাজারের সবচে’ কম দামের ক্যামেরা।
কোরবানীর ঈদ মাত্র দুদিন পরে। রুমে ফিরেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম, নাউ আই হ্যাভ আ ক্যামেরা… গোয়িং টু মম উইথ মাই নিউলি বট ক্যামেরা …. !
আব্বা আম্মা অনেক অবাক হয়েছিল.. এই আমি … দশ হাজার (!) টাকা খরচ করে একটা ক্যামেরা কিনেছি!! তাদের বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বোকার মতো হাসি, কিনলাম অবশেষে… হে হে হে …। ক্যামেরা দিয়ে প্রথম ছবিটা তুললাম…. আম্মাকে, আম্মার স্মাইলি ক্লোজআপ!
ক্যামেরা কেনার তৃতীয় দিনে, ঈদের দ্বিতীয় দিনে, ক্যামেরা পকেটে নিয়ে বের হলাম, ইচ্ছে গ্রামের বাড়িতে যাবো… সবার সাথে দেখা করার আগে ফটোগ্রাফি হবে বেশ! মেজো ভাই বললো, ‘আয় তোকে মটরসাইকেল চালানো শিখিয়ে দিই’… আমিও রাজী হয়ে গেলাম। দুটো রাউন্ড দিয়ে এলাম, কোন সমস্যা হলো না। এবার দুরত্বটা একটু বেশী, কারন ফিরে এসেই গ্রামে যেতে হবে। কিন্তু বাইক নিয়ে নেমে গেলাম সোজা পাশের ডোবা-তে। আমি ডুবলাম, বাইক ডুবলো.. কেউ দেখলো না। লোকজনের সহায়তায় বাইক তুললাম, পকেট থেকে বের করলাম আমার সাধের ক্যামেরা। ডোবার পচা পানি খেয়ে পেট নষ্ট হয়েছে তার, তাই আর চালু হলো না… মাত্র তিন দিনে শেষ হলো আমার প্রথম ক্যামেরাটা, এক দিনে তিন হাজার তিনশ তেত্রিশ টাকা করে। সব মিলিয়ে ৩৫টা ছবি তুলেছিলাম …
সার্ভিস সেন্টারে দিয়েছিলাম… ওরা একমাস পরে জানালো ৫০০০ টাকা লাগবে সারতে। আমি আর যাই নি, ক্যামেরাটা রয়ে গেছে তাদের কাছে, ছবিগুলোও।
এখন একটা ডিএসএলআর কেনার স্বপ্নকে বড় করছি, পুষে রাখছি নানান অবাস্তব আর অসম্ভব কল্পনার মাধ্যমে। প্রত্যেক ছুটিতে বাড়ি যাই আর পুরো সময়টাতে ক্যামেরার জন্য আফসোস করি, একটা ডিএসএলআর, নিদেনপক্ষে একটা নাইকন ডি৪০, মাত্র ৩৭ হাজার টাকা… … হয়ে যাবে কোন একদিন, অবশ্যই হবে, দিন তো আর সবসময় সমান যায় না …
ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরা থাকেনা, ছবিও উঠে না
এই গল্পের একটা সমাপ্তি আছে… কদিন আগেই গত ১২ ফেব্রুয়ারী সেন্ট মার্টিন গিয়েছিলাম অফিসের পিকনিকে। যথারীতি ক্যামেরাটা আমার হাতেই। একদিন দুইরাতের ট্যুরে সাধারণ পেন্সিল ব্যাটারী বারবার পাল্টে নিয়ে মোট ছবি তুললাম ৪৫৩ টি, আমার ছবি একটিই, সেটাও ব্যাকগ্রাউন্ডে… ক্যামেরাটা আরেকজনের হাতে দিয়ে যখন পানিতে নেমেছিলাম, তখনই …
সমস্যা নেই, ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরা থাকেনা, ছবিও উঠে না …
Vai last e ki holo abar o ki jole gelo?
না ভাই। এবারেরটা জলে নয়, চোরের পকেটে গেছে।