কুয়াকাটা: স্বপ্নপূরণ এবং স্বপ্নভঙ্গের গল্প

স্বপ্নসাধ

কুয়াকাটা যেতে চাই অনেকদিন ধরেই। যাওয়া হচ্ছিল না বিভিন্ন কারণে – বিশেষতঃ সময় আর সামর্থ্যের অভাবে। ঈদের পরে গেলাম পটুয়াখালীতে বন্ধু জহিরুল মুসাদের বাড়িতে। প্ল্যান করেই যাওয়া – পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা যাবো। কুয়াকাটার এত নাম শুনেছি কিন্তু ওখানে দেখার কি আছে তা-ই ভালো করে জানা নাই। আগে থেকে খোঁজ খবর করে গেলে সেই অনুযায়ী প্ল্যান ঠিক করা যায়। তাই একে ওকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, কিন্তু কেউ-ই বিশেষ কিছু বলতে পারলো না, সি বিচের কথা ছাড়া। তারপরও যাই হোক .. যাবো বলে বেরিয়েছি, যাবোই।

রিচার্জিং ড্রিম

জহিরুল মুসাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কুয়াকাটা সম্পর্কে। সে খুব আশাব্যাঞ্জক কথা বললো না। দেখার মতো আছে সি বিচ, তবে রাস্তা খুব একটা ভালো না। অনেক সময় লাগবে আর কষ্টও হবে – এই সব শুনে নতুন করে ভাবতে বসলাম যাবো কিনা। তবে জহিরুলের উপরই সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার দেয়া হলো। সে বললো, বিবিসি তে নাকি শাকিল নামের রিপোর্টার কুয়াকাটা সম্পর্কে রিপোর্ট করতে গিয়ে সবশেষে বলেছিল “এত কষ্ট করে কুয়াকাটা এসে পৌছামাত্র ভুলে যাবেন সকল কষ্ট, সুতরাং ..” এই বাক্যই আমাদেরকেও চার্জিত করলো, নতুন উদ্যম যোগ হলো … যাবোই।

কুয়াকাটার পথে

বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যেতে হবে বাসে। কুয়াকাটা পর্যন্ত বাস আছে, আবার ভেঙ্গে ভেঙ্গেও যাওয়া যায়। কুয়াকাটা পর্যন্ত বাস ভাড়া লাগল ১৫০ টাকা। পটুয়াখালীতে নেমে বাস পাল্টালে ভাড়া একই পড়বে – ৬০ + ৯০ টাকা। এইটা ঈদের ভাড়া বোধহয়। নরম্যালি ২০-৩০ টাকা কম খরচ পড়বে। যেতে সময় লাগে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা।

বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যেতে পাঁচটি ফেরী পার হতে হয় – দপদপিয়া, লেবুখালী, কলাপাড়া , আলীপুর এবং মধুপুর। প্রথম দুটো পটুয়াখালী যাবার আগে, বাকীগুলো পরে। এর মধ্যে দপদপিয়া আর মধুপুর ফেরীগুলো এত ছোট দুরত্বের যে আপনি সকল সরকারকে গালি দিতে ভুলবেন না। কারন একটি করে সেতু নির্মানের মাধ্যমেই সময় এক ঘন্টা কমিয়ে আনা সম্ভব।

কলাপাড়া ফেরী থেকে শুরু করে প্রতিটি ফেরী পার হতে গিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন সমুদ্রের কাছে আসছেন … পানির রং পাল্টাচ্ছে, ঢেউ এর উচ্চতা বাড়ছে, আর বাড়ছে সমুদ্র গামী বিশাল ট্রলারের সংখ্যা। যারা ফটোগ্রাফি পছন্দ করেন তারা দপদপিয়া ফেরী পার হবার পরে প্রচুর ল্যান্ডস্কেপ পাবেন আর মধুখালী ফেরীতে পার হবার সময় তো অবশ্যই ক্যামেরা ওপেন করতে হবে। এত এত সমুদ্রগামী ট্রলার, তার প্রত্যেকটির মাথায় দুতিনটে করে বিভিন্ন রঙ এর পতাকা … অসাধারণ। কিন্তু সময় পাবেন খুব কম, সতুরাং ক্লিক ক্লিক ক্লিক ক্লিক ….

আমিনুর পর্ব

আমিনুর এর সাথে পরিচয় হলো কুয়াকাটা নেমে গেস্ট হাউস আনন্দবাড়ীতে। সে স্থানীয় ছেলে, মৌচাক কেটে আর জমির দালালী করে জীবিকা নির্বাহ করে। তার কাছে জানতে চাইলাম, কুয়াকাটায় কি কি দেখার আছে। সে যে জবাব দিল তা খুবই ইন্টারেস্টিং … কুয়াকাটায় দেখার কিছুই নাই, মাইনষে যে ক্যান আসে আল্লাই জানে … আছে নারিকেল গাছ .. এর মইদ্যে দেখার কি আছে বলেন? আর আছে বাড়ি… কটেজ, বিল্ডিং .. এই গুলা কি দেখার জিনিস? আপনারা ডাব খান, আমরা ১০ টাকার ডাব বেচি ২৫ টাকায় … পাঁচ টাকার রিকশা ভাড়া নিই বিশ টাকা … আসল কথা হৈল, আপনাদের মতো পোলাপাইন আসে মাস্তি করতে .. শহরে পারে না, তাই এইখানে আইসা সবাই মিইলা মউজ করে … বোঝেন তো … মদ টদ খায়, মাইয়া নিয়া ফুর্তি করে … দেখার কিছুই নাই … ”

আমরা তিনজনে অবাক হয়ে তার কথা শুনছি আর মিটিমিটি হাসছি, শেষে বলেই ফেললাম.. ” আপনি দুনিয়ায় বাইচা আছেন ক্যান বলেন তো? এই দুনিয়ায় তো মনে হয় দেখার কিছুই নাই …”;)

কি কি দেখবেন?

সব মিলিয়ে পুরো একদিন ছিলাম কুয়াকাটায়। এর মধ্যে সবার সাথে কথা বলে এবং নিজেরা ঘুরে ঘুরে যা জানতে পেরেছি তার মধ্যে দ্রষ্টব্য স্থানসমূহ হলো :

  • কুয়াকাটা বিচ – সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয় এবং রাত্রীযাপন
  • কুয়াকাটার কুয়া যার নাম অনুসারে এই জায়গার নামকরন করা হয়
  • ফাতরা বন – সুন্দরবনের প্রান্তসীমা
  • ঝাউবন – সূর্যদয় দেখার জন্য উৎকৃষ্ট স্থান
  • রাখাইন পল্লী … খুবই ছোট এবং বিশেষ কিছু চোখে পড়ার মতো নয়, সময়ের আবর্তনে তাদের চেহারা আর পোষাক ছাড়া আমাদের সাথে তেমন কোন পার্থক্য নাই
  • এশিয়ার সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ মন্দির
  • সমুদ্রের মাছ নিয়ে একটি মিউজিয়াম
  • মৎস্যপল্লী – তবে শীতকাল ছাড়া এখানে দেখার তেমন কিছু নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির কারণে শুটকি তৈরী হয়না বললেই চলে

মিজানুর পর্ব

মিজানুর লোকাল ছেলে। ক্লাস এইটে পড়তো, কিন্তু বাবার সাথে রাগ করে মাস তিনেক আগে পড়া ছেড়ে দিয়েছে, এখন ভ্যান চালায়। খুবই ভদ্র ছেলে এবং আমাদের ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের জন্য অপেক্ষা করা, গভীর রাতে সি-বিচে নেয়ার জন্য উপস্থিত হওয়া, বিচে বেঞ্চির ব্যবস্থা করে দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। খুব ভালো হয় যদি আপনারা এমন কারও সাথে ম্যানেজ করে নিতে পারেন, কারন ওখানে ভ্যানচালক এবং মোটর সাইকেল চালকরা পর্যটকদের গলা কাটতে প্রস্তুত। তাছাড়া, বিভিন্ন রকম সহায়তা পাবেন তাদের কাছ থেকে।

গেস্টহাউস পর্ব

কুয়াকাটায় সরকারি এবং বেসরকারী অনেক গেস্টহাউস, রেস্টহাউস এবং হোটেল আছে। আমরা উঠেছিলাম আনন্দবাড়ি গেস্ট হাউসে। সেবার পরিমান বিভিন্ন। সিঙ্গেল রুমের জন্য ৪০০-৫০০ টাকা এবং ডবল বেডের জন্য ৮০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত প্রদান করতে হতে পারে। তবে ডাবল রুমগুলো পর্যাপ্ত বড়, অনায়াসে চারজন থাকতে পারবেন। খোঁজ খবর নিয়ে এবং বুকিং দিয়ে গেলে ভালো হয়, তবে বুকিং না দিলেও সমস্যা নেই, কোথাও না কোথাও সিট পেয়ে যাবেন। না পেলে সমুদ্রেই রাত্রি যাপন করবেন … 😉 তবে মালপত্র রাখা এবং গোসল করার জন্য রুম বুকিং দেয়াই উত্তম।

আনন্দবাড়ি গেস্ট হাউস কুয়াকাটা
আনন্দবাড়ি গেস্ট হাউস, কুয়াকাটা। এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

আমাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো হয় নি … আটশ টাকা দিয়ে রুম বুকিং নিয়ে রাতে ঘুমিয়েছি এক রুমে আর টিভি দেখা এবং বাথরুম সেরেছি আরেক রুমে 😉 😉

ইতিবাচক দিক

বিচটা আসলেই অসাধারণ, ভিড় তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আর কক্সবাজারের তুলনায় খুবই কম নোংরা। কুয়াকাটা বেশ নিরাপদ জায়গা, চাকু-পিস্তল ঠেকিয়ে লুটে নিয়ে যাবে – এরকম বিপদের সম্ভাবনা খুবই কম। খাবার তুলনামূলক ভাবে সস্তা। ৫০ টাকা দিয়ে মুরগী/গরু, আর ৪০ টাকা দিয়ে টাটকা ইলিশ খেতে পারবেন।

নেতিবাচক দিক

রাস্তা ভয়াবহ খারাপ। আলীপুর ফেরী পার হবার পর প্রায় দশ কিলো রাস্তা ভয়াবহ খারাপ। একমুহুর্ত ঝাঁকুনি ছাড়া চলা সম্ভব না। এক জায়গায় তো বাস ৩৫ ডিগ্রি বেঁকে গেল (অবশ্য যাত্রীরা আগেই বাস থেকে নেমে দাড়িয়েছিল)। এই জায়গায় বাস বাদ দিয়ে ‘ঘোড়া সার্ভিস’ চালু করা যেতে পারে।

সামুদ্রিক ঝিনুক এবং অন্যান্য জিনিস দিয়ে তৈরী পণ্য পাওয়া যায় যার দাম চড়া। কারণ সব পণ্যই কক্সবাজার থেকে আমদানী করতে হয়।

রিকশাভ্যান ভাড়া বেশী। বিচের কাছাকাছি কোথাও উঠলে এই সমস্যা কাটানো সম্ভব।

স্বপ্নপূরণ নাকি স্বপ্নভঙ্গ?

অবশ্যই স্বপ্নপূরণ। অন্ততঃ কুয়াকাটায় পৌছার পর। বিচে পৌছামাত্রই বিবিসির রিপোর্টারর সাথে একমত হলাম। আমাদের তৃতীয় বন্ধু সাবিত তো বিচ ছাড়া আর কোন জায়গায় ঘুরতেই গেল না। অনেক রাত পর্যন্ত বিচে থাকতে পারবেন, চাই কি সারা রাত কাটিয়ে দিতে পারেন। তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডাও বাড়তে থাকে। ফটোগ্রাফীর জন্য অনেক অপরচুনিটি। ভিড় কম, শান্তিতে ঘুরতে পারবেন।

তবে এটা ঠিক যে কুয়াকাটায় বিচ ছাড়া দেখার উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই, মৎস্য পল্লী আর বৌদ্ধ মন্দির দেখা ছাড়া। রাখাইন পল্লী দেখতে হলে বৌদ্ধ মন্দির এর নিকটস্থ পল্লীতে গেলেই ভালো।

কুয়াকাটায় যাবার সময় আশা ছিল … পৌছানোর পর পরই সকল কষ্ট ভুলো যাবো সামুদ্রিক বাতাস আর উষ্ম পানির ছোয়ায়। ফেরার সময় আশঙ্কা … ফেরার পর কষ্ট ভুলিয়ে মন ভরাবে কি?

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *