জীবনের শেষ প্রেমপত্র

প্রিয় লাবনী,
গত প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে পোস্টাফিসের চিঠি লেখা এবং ফেলার বিশাল বাক্সের সামনে দাড়িয়ে আমি শুধু একটা চেষ্টাই করে যাচ্ছি – তা হলো প্রাণের প্রিয়াকে একটি প্রেমপত্র লেখা। প্রথম পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছে একজন মানুষ দাড়ানোর মতো প্রয়োজনীয় জায়গা করে নেয়ার জন্য। কে জানে কেন আজকেই সবাই পোস্ট অফিসে এসে চিঠি লেখা কিংবা মানি অর্ডার পূরণ করছে। বাকী আধাঘন্টায় লিখলাম মাত্র এতটুকু কারণ এই আধাঘন্টা চিন্তা করে কাটিয়েছি তোমাকে কি লিখবো এবং কিভাবে লিখবো সেটা নিয়ে। হাজার হলেও তোমাকে এখন যে চিঠিটি লিখছি সেটা ‘স্পেশাল’ – কারণ, তোমার কাছে, এবং সম্ভবত আর কারও কাছে কোনদিনই নয়, আমি আমার জীবনের সর্বশেষ প্রেমপত্রটি লিখছি।
গত চল্লিশ মিনিট ধরে কিছুক্ষন পর পর আমাকে তাড়া দিয়ে যাচ্ছে “প্যাশেন্ট ইমরান” যার বাংলা হলো ‘ধৈর্য্যশীল ইমরান’। প্যাশেন্ট ইমরানকে চিনতে পারছো তো? তোমার সাথে যখনই আলাদা দেখা করতাম, যাকে কিনা ‘ডেটিং’ বলে, আমার বন্ধু ইমরান ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে, বাদাম ছিলে, চিবিয়ে গলধ:করণ করে কিংবা গোল্ডলিফ সিগারেটে টান দিয়ে অপেক্ষা করতো কখন আমার কথা শেষ হবে – তাই তুমিইতো তার নাম দিয়েছিলে ‘প্যাশেন্ট ইমরান’। কিন্তু সেই ধৈর্য্যশীল ইমরান আজ কেন এত ইমপ্যাশেন্ট হয়ে তোমার কাছে আমার সর্বশেষ প্রেমপত্রটি লিখতে বাধা দিচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি না।
আমার নাম যদি নাজমুল হাসান না হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা নজরুল ইসলাম হতো, নিদেনপক্ষে হুমায়ূন আজাদ তবে নিশ্চয়ই আমার প্রেমপত্রটি ছাপার অক্ষরে প্রথমে কোন জাতীয় দৈনিক কিংবা মাসিকের বিশেষ সংখ্যায় এবং পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশিত হতো এতে কোন সন্দেহ নেই। লাবনী, তোমার হাতে যথেষ্ট সময় আছে তো? আমি কিন্তু একটি বিশাল চিঠি লিখতে যাচ্ছি। টেলিগ্রামের আকারে পাঠাতে পারলে বেশ মজাই হতো, কিন্তু জানোই তো এই ইমেইলের যুগে টেলিগ্রামে মোটেই কাজে লাগে না বলে সরকার বছর তিনেক আগেই টেলিগ্রাম সেবাটি তুলে দিয়েছে। এটা অবশ্য আমার ভাগ্যি, কারণ পকেটের অবস্থা চিন্তা করতে হচ্ছে, আগামী কাল কিংবা আজ থেকেই যে খরচের ধাক্কাটা শুরু হবে সেটা সামলানোর জন্য পকেটে টাকা থাকা বাঞ্ছনীয়, হিসেবজ্ঞান তো অবশ্যই। মনে পড়ে, তোমাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে যে টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছিলাম?
সুখপাখি আমার, আমি কোন পোস্টাফিসে দাড়িয়ে তোমাকে চিঠি লিখছি সেটা কি তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না? অবস্থানটার বর্ণনা দিলেই চিনতে পারবে। আগ্রাবাদের সেইন্ট মার্টিন হোটেলের উল্টোদিকে সিজিএস বিল্ডিং এর ভেতরে যে পোস্টঅফিস, আমি সেখান থেকেই লিখছি। আরও পরিস্কার করে বলি, তোমার জন্মদিনে একবার আমরা সারদিন ঘুরেছিলাম, চাইনিজে গিয়েছিলাম – মনে আছে? তার আগে তোমাকে সহ যে পোস্ট অফিসে গিয়ে আমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় শেষ সম্বলটুকু তুলে নিয়েছিলাম – আমি সেই পোস্ট অফিসে দাড়িয়ে আছি।
লাবনী, তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হবার সময়টার কথা কি মনে আছে? একদিন আমি আর ইমরান চট্টগ্রামের পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম, কাউন্টারে ব্যাগ জমা দিয়েছিলাম বলে ওরা আমাকে ১০১ নম্বর লেখা একটি গোল টোকেন দিয়েছিল আর আমি সেটা নিয়ে খেলছিলাম। লাইব্রেরিতে সবাই পড়তে গেলেও আমরা ঢালু সিড়ি দিয়ে টোকেনটা গড়িয়ে দিচ্ছিলাম, কিংবা সমতল মেঝেতে, আর তুমি অবাক হয়ে দেখছিলে – এত্ বড় ছেলেগুলি কিভাবে বাচ্চাদের মতো আচরণ করছে? তখনই তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম এবং আমি স্বীকার করি, অন্য সব মেয়ের প্রেমে পড়ার মতোই তোমাকেও আমি প্রথম দেখেই তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। নিজের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট আস্থা ছিল কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবিস্কার করলাম, আমি পাচফুট আট ইঞ্চি উচ্চতা আর তেষট্টি কেজি ওজন বিশিষ্ট একটা নিরেট গাধায় পরিণত হয়েছি। কারণ প্রথম দেখায় আমি সব মেয়ের প্রেমে পড়লেও শীঘ্রই উঠে পড়তাম, কিন্তু তোমার বেলায় সেটা আর সম্ভব হয় নি।
তোমাকে দ্বিতীয়বার দেখলাম কলেজে। আমি জানিনা তুমি আমাকে চিনেছিলে কিনা, কখনো জিজ্ঞেসও করা হয় নি কারণ আমরা যখনই একত্রিত হতাম তখন বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে আমরা এত বেশী মগ্ন থাকতাম যে অতীত আমাদের দরজায় মাথা ঠুকে মরতো। তোমার সাথে প্রথম কবে কথা বললাম সেটা মনে আছে লাবনী?
তোমাকে যেদিন মুখে প্রথম ভালোবাসার কথা বললাম সেদিন আমার সে কি দুরাবস্থা! অনেক আগে থেকেই আমি এ সমস্যায় ভুগছি। স্টেজে অতিথির কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহন করতে গেলে কিংবা সুন্দরী কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলে আমি এমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই যে তখন কি বলি আর কি করি তা নিজেরই মনে থাকে না। অনুভব করতে পারছিলাম আমার ডান কানটি ক্রমশই টকটকে লাল আর গরম হয়ে যাচ্ছিল। আগে ভাবতাম এটা বুঝি লজ্জায় হয়, পরে জানলাম – লজ্জা নয়, অ্যালার্জি।
তোমার সাথে প্রথম ডেটিং এর ক্ষনটুকুর কথাও মনে পড়ে গেল। কলেজ বন্ধ থাকলেও কলেজের গেটে দেখা করার কথা ছিল। তুমি আমাকে দেখেই বললে, ‘গায়ে কি আফটার শেভ মেখে এসেছো? মোজায় এত গন্ধ ক্যান?’ তুমি কেন এই কথা বলেছিলে তা আমি জানি না কিন্তু আমি তখন কোন লজ্জা পাইনি। ভাজা বাদামের সাথে লজ্জা-শরম নামক বস্তুটাকে আমি চিবিয়ে গলধ:করন করে হজম করে ফেলেছিলাম। নচিকেতার ঐ গানের চরনটা মনে হয় আমার জন্যই লেখা –

‘লাঞ্ছনা গঞ্জনা মাখা অভিযোজনে, রপ্ত করেছি নিজেকে’

তোমাকে যতবারই বিয়ের কথা বলেছি ততবারই তুমি হেসেছো অর্থহীন কিন্ত অর্থপূর্ন হাসি। আমি জানতাম তুমি আমাকে ভালোবাসো কিন্তু সেটা কিরকম সেটা জানি না। তোমার এরূপ আচরনে আমার অবস্থা করুন থেকে করুনতর হলো। চুলে তেল নেই, উস্কোখুস্কো, শার্টের কলারে ময়লার দাগ, ইস্ত্রিবিহীন প্যান্ট। একদিন তুমিই দেখিয়ে দিয়েছিলে আমি গত একসপ্তাহ ধরে কাকের গু শার্টে নিয়ে ঘুরছি। মানসিক অবস্থা যে কিরকম ছিল সেটা আমি নিজেও জানতাম না, তোমাকে কি বলবো। মাঝে মাঝে মনে হতো তোমাকে জোর করে বিয়ে করে ফেলি কিন্তু সাহসে কুলায় নি। তোমাকে ভুলে যেতেও চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। তুমি আমাকে একচেটিয়া ভাবে চালিত করেছো, তোমার অনুগত থেকেছি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত।
কিন্তু লাবনী সে সময়ের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে, আর একটা মাত্র দিন তারপরেই মুক্তি। আমি আর তোমার অনুগত থাকবো না। শুধু তুমি কেন, কোন নারীরই অনুগত হয়ে থাকবো না। এতদিন আমি তোমার দ্বারা চালিত হয়েছি আগামীকাল থেকে আমি কাউকে পরিচালিত করবো। এতদিন চেষ্টা করেও যা পারিনি তা আগামীকাল করবো। এখান থেকে বেরিয়ে আমি কেনাকাটা করতে যাবো। জানি এ চিঠি যখন তোমার কাছে পৌছুবে তখন আমি এখনকার মতো থাকবো না, পরিবর্তনটুকু ঘটে যাবে। কারণ  বাংলাদেশের মতো দেশে শহরের মধ্যেই চিঠি যেতে দুদিন সময় লাগে, দেরী হলে কত সময় লাগবে সেটা স্রষ্টা জানেন।
লাবনী তোমাকে একটা সুখবর জানানোর জন্য এ চিঠি লেখা। জানিনা তুমি খুশি হবে কিনা কিন্তু আমি খুশি হবো সবচে বেশী। আগামীকাল থেকে আমি যে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি তার জন্য প্রার্থনা করো লাবনী। সুখবরটা দিয়েই শেষ করছি লাবনী। তবে তার আগে তোমার জন্য শুভকামনা জানাই – জীবনে সুখী হয়ো লাবনী। সুখবরটা হলো, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি, আগামীকাল দুপুরে।

নাজমুল হাসান দারাশিকো
এখনো ‘বর্তমান’, আগামীকাল থেকে তোমার ‘সাবেক’ প্রেমিক

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *