গ্রীষ্মের তাপ থেকে মুঘলরা কিভাবে বাঁচতেন

জলমহাল গ্রীষ্মের তাপ থেকে বাঁচতে তৈরি

গ্রীষ্মের তাপ অসহ্য সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এই গরম যখন স্বাভাবিকের মাত্রাকে অতিক্রম করে তখন ‘অস্বাভাবিক গরম’ সংবাদের শিরোনাম হয়, তুলনার বস্তুতেও পরিণত হয়। এ বছর বৈশাখ শুরুর আগেই তীব্র তাপপ্রবাহ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। আবহাওয়াবিদগণ প্রতিদিনের তাপমাত্রা রেকর্ড করে তা কত বছরের পুরাতন রেকর্ড ভঙ্গ করেছে তা জানিয়েছেন। সে তথ্য মোতাবেক, এ বছর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৪ ডিগ্রি যা বিগত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

দিল্লীর তুলনায় ঢাকার এই তাপমাত্রা অনেক কম। গ্রীষ্মের তাপমাত্রার জন্য দিল্লী অনেক আগে থেকেই সুপরিচিত। গেল বছর দিল্লীতে ৪৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। বলা হয়, এপ্রিল থেকে জুনে দিল্লীতে গড় তাপমাত্রা থাকে ৪০-৪৫ ডিগ্রি। এক বা দেড়শ বছর আগে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হতো না। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায় – গ্রীষ্মকাল তখনও তীব্র তাপদাহী ছিল।

এই যুগে তীব্র গরম থেকে বেঁচে থাকার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্রই একমাত্র ভরসা। তাপমাত্রার পারদ এবং এসি বিক্রয়ের সূচক একইসাথে বাড়ে আর কমে। যখন এই যন্ত্র ছিল না তখন দিল্লীবাসী কী প্রক্রিয়ায় এই তাপদাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতো তার বর্ণনা বিভিন্ন ঐতিহাসিকের সূত্রে জানা যায়। সাধারণত দুটি উপায় অবলম্বন করা হতো – অপেক্ষাকৃত শীতল স্থানে গমন এবং গ্রীষ্ম উপযোগী বাসস্থান নির্মান।

গ্রীষ্মের তাপ থেকে বাঁচতে মুঘলরা কি করতেন

দিল্লীর তাপমাত্রা যখন চরমে তখন অপেক্ষাকৃত শীতল স্থানগুলোর তাপমাত্রা সহনীয়। দিল্লীর শাসক থেকে শুরু করে সম্ভ্রান্ত এবং সম্পদশালী লোকদের সাধারণ গন্তব্য ছিল কাশ্মীর। গ্রীষ্মের সময়টা তারা কাশ্মীরে কাটিয়ে দিতো, ওখানে বসেই প্রশাসনিক কাজকর্মও পরিচালনা করতো। কাশ্মীরে মুঘলদের তৈরি অনেক স্থাপনা আজও দেখতে পাওয়া যাবে। হিমাচল, উত্তরখণ্ড – গরমকালে এইসব স্থানেও শান্তি খুঁজতো মুঘলরা।

উইলিয়াম ড্যালেরিম্পল তার ‘দিল্লী দ্য সিটি অব জিনস‘ বইতে একাধিকবার দিল্লীর তীব্র গরমের অভিজ্ঞতা লিখেছেন। মুঘলদের সম্পর্কে লিখেছেন, “ভারতের যে কোন প্রধান শহরের চাইতে দিল্লী সবসময় অধিক গরমের কবলে পড়ে। মহান মোগলেরা তাদের পূর্বপুরুষদের যাযাবর জীবনের কথা স্মরণ করে গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহের সমস্যা কাটিয়ে উঠার জন্য পুরো দরবারকে গ্রীষ্মের মেয়াদে কাশ্মীরের শীতলতার মধ্যে নিয়ে যেতেন। প্রমোদ উদ্যানে পারস্যের গালিচায় গা এলিয়ে দিয়ে তারা আরামে সম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। কখনো তারা ডাল লেকে মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠতেন।”

গ্রীষ্মের তীব্র তাপমাত্রা থেকে বাঁচতে মুঘলদের তৈরী বিভিন্ন অবকাঠামো আজও প্রশংসনীয়। ভারতবর্ষে মুঘলদের তৈরী বিভিন্ন দুর্গ ও অন্যান্য বাসস্থানগুলো এমনভাবে তৈরী করা হয়েছিল যেন তা স্থানীয় পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। দিল্লীতে অবস্থিত মুঘল আমলের বাড়িগুলো এর প্রমাণ। ভবনগুলো এমনভাবে তৈরী করা হয়েছিল যেন ছায়া ও পানিকে ব্যবহার করে গ্রীষ্মের তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়। তাজমহলের রহস্যময় বাইশ কক্ষ নির্মাণের পেছনেও কারণ এটি বলে ধারণা করা হয়। সম্পদশালী ব্যক্তিরা গ্রীষ্মের তাপমাত্রা থেকে বাঁচার জন্য তাদের হাভেলির মধ্যে তাহখানা নির্মাণ করতেন।

তাহখানা

তাহখানা হলো এমন ঘর যা সাধারণত মাটির নীচে এমনভাবে তৈরী করা হয় যেন সেখানকার তাপমাত্রা শীতল হয়। তাহখানার অভ্যন্তরে জলাধার থাকতো অথবা পানি আসা যাওয়ার ব্যবস্থা থাকতো। এছাড়া, বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকার কারণে বাহিরের তীব্র তাপমাত্রা অভ্যন্তরে প্রবেশ করতো শীতল হয়ে। সে সময়ে নির্মিত অনেক মসজিদেও তাহখানা ছিল।

এই তাহখানাগুলোকে মাটির নীচের ছোট ঘর ভাবলে ভুল হবে। যেহেতু গ্রীষ্মের সময়টা কাটিয়ে দেয়া হতো – সেহেতু তাহখানাগুলোকে নির্মান করা হতো যথেষ্ট বড় করে। দিল্লীর লাল কেল্লায় রংমহলের নীচে যে তাহখানা ছিল সেটা আয়তনে উপরের অংশের মতই বিশাল ছিল। গ্রীষ্মের সময় সেখানে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য সকল ব্যবস্থা ছিল। দিল্লীতে ব্রিটিশ সরকারের শাসক ছিলেন কর্নেল স্কিনার। বলা হয়, তিনি তার হাভেলিতে যে তাহখানা নির্মাণ করেছিলেন সেখানে পানিকে বরফ বানানো যেতো!

বাওলি

আরেক ধরণের স্থাপনা ছিল যাকে বলা হতো বাওলি। এটি এক ধরণের জলাধার। মাটি খনন করে যেভাবে কূপ নির্মান করা হয়, বাওলি-ও সেরকম, তফাৎ হলো – বাওলি তৈরী করা হতো বিশাল পরিসরে এবং মাটির অভ্যন্তরে। সেখানে অনেকগুলো স্তর (ফ্লোর) থাকতো, সিঁড়ি নেমে যেতো গভীরে। ভারতের অনেকগুলো বাওলি এখন পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য কারণ এগুলোর নির্মান কৌশল চমৎকার এবং কারুকার্যময়। মুঘল প্রাসাদগুলোতে যে বাওলি ছিল সেগুলো ছিল রাণী ও সভ্রান্ত নারীদের সময় কাটাবার স্থান।

জলমহাল

মুঘলরা ছাড়াও আগের ও পরের রাজা-বাদশাদের সময়ে তৈরি বিভিন্ন জলমহাল ছিল গ্রীষ্মের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়। বিশাল জলাধারের মধ্যে ও চারিদিকে পুরু দেয়াল দিয়ে বসবাসের জন্য ঘর তৈরী করা হতো। পানি এবং দেয়ালের পুরুত্বের কারণে এই সকল ঘরের অভ্যন্তরে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা অনুভব করা যেতো না। উত্তর ও মধ্যপ্রদেশে এ ধরণের অনেকগুলো জলমহালের অস্তিত্ব এখনও রয়েছে।

সে সময় যারা সম্পদশালী ছিল না তারা কিভাবে গ্রীষ্মের এই তাপদাহ থেকে বেঁচে থাকতো সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রজাদের ঘর সাধারণত মাটির দেয়ালে তৈরী ছিল, ফলে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই গ্রীষ্মের তাপ প্রবেশ করতো না। ইটের তৈরী ঘরের বাসিন্দারা রাতে ছাদে খোলা আকাশের নীচে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতেন। বলা হয়, কুলফি বরফ জনপ্রিয় হয় দিল্লীর এই তীব্র তাপমাত্রার কারণেই।

বর্তমানকাল

ভারতে গ্রীষ্মকালের তীব্র তাপমাত্রা বর্তমানে অহসনীয় হয়ে উঠায় ভারত সরকারের তরফ থেকে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ হয়েছে। যেমন: ২০১৯ সালে গ্রহণ করা হয়েছে ‘ইন্ডিয়া কুলিং একশন প্ল্যান’। এই পরিকল্পনায় গ্রীষ্মের তাপমাত্রা যেন আবদ্ধ হয়ে না থাকে এবং বায়ু চলাচলের মাধ্যমে যেন ঠান্ডা রাখা যায় সেজন্য কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিককালে স্থপতিরা ভারতের ইতিহাস থেকে গ্রীষ্মের তাপ থেকে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে আগ্রহী হয়েছেন।

এরকম একটি উপায় হলো ‘জালি পর্দা’র ব্যবহার। ‘জালি পর্দা’ হলো জালের মতো দেখতে দেয়াল যা সাধারণত মার্বেল বা লাল পাথর কেটে তৈরী করা হতো। ছিদ্রযুক্ত হওয়ায় এর ভেতর দিয়ে আলো বাতাস চলাচল করতে পারে। আগ্রার তাজমহল কিংবা জয়পুরের হাওয়া মহলে এই জালি দেয়াল দেখতে পাওয়া যায়। আলো-বাতাস চলাচল ছাড়াও এই ধরণের জালি পর্দা হিসেবেও ভূমিকা রাখে। মজার ব্যাপার হলো – এই ছিদ্রযুক্ত জালি দিয়ে বাহিরের তীব্র তাপমাত্রাযুক্ত বাতাস কিছুটা শীতল হয়ে প্রবেশ করে, আবার ইটের তৈরি দেয়ালের মতো তাপকে আবদ্ধ করে রাখে না। জালি দিয়ে নির্মিত দেয়াল সাধারণত মূল ভবন থেকে কিছুটা আলাদা হয় যা বাহিরের তাপমাত্রাকে মূল ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেয় না।

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে উত্তর ভারতে মাইক্রোসফটের কার্যালয় নির্মান করা হয়েছে। এর বাহিরের দিকের দেয়ালটি সম্পূর্ণরূপেই জালি দেয়াল দিয়ে তৈরী। নির্মাণ স্থাপত্যের কারণে ভবনটি আমেরিকার গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিলের সর্বোচ্চ রেটিং ‘লিড প্লাটিনাম রেটিং’ স্বীকৃতি পেয়েছে। নয়াদিল্লীতে পাঞ্জাব কেসারি নামের সংবাদপত্রের প্রধান কার্যালয়েও জালি পর্দা ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মিত হোটেল, অফিস কিংবা আবাসিক স্থাপনায় এই জালি পর্দা ব্যবহার করা হচ্ছে। সকল ক্ষেত্রেই এর নির্মাতা বলছেন, এর মাধ্যমে বাহিরের তীব্র তাপমাত্রা অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের উপর চাপ কমে।

মুঘলদের স্থাপত্যবিদ্যা ঢাকায় ব্যবহারের সুযোগ বললেই চলে কারণ ঢাকার জলাধারগুলোর সবই ভরাট করে ফেলা হয়েছে৷ তবে বহুতল ভবনগুলোতে কাঁচের ব্যবহার কমিয়ে জালি পর্দার ব্যবহার করার সুযোগ এখনও আছে। হয়তো এদেশের স্থপতিরা গ্রীষ্মের তীব্র তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার সস্তা কিন্তু নান্দনিক কোন উপায় বের করবেন, ঢাকা সহ সারা দেশে তার ব্যবহারে তীব্র তাপ থেকে রক্ষা পাবে সবাই।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *