ডেইলি স্টার পত্রিকায় গুটিকয়েক বড় কোম্পানীর সিন্ডিকেটের কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের স্বাধীন মুরগি খামারিরা বাধ্য হয়ে সেই কোম্পানীগুলোর চুক্তিভিত্তিক খামারিতে পরিণত হচ্ছেন তার একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ হলো এমন পদ্ধতি যেখানে কোম্পানীগুলো খামারিকে বাচ্চা, খাবার ইত্যাদি বিনামূল্যে সরবরাহ করবে এবং খামারি প্রতি কেজিতে নির্ধারিত লাভে কোম্পানীর কাছেই বিক্রয় করবে। বাজারে কি দামে বিক্রি হবে সেটা ঠিক করবে কোম্পানীগুলো, বিক্রয়ের দায়িত্বও তাদের।
কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এ না গিয়ে আপনি যদি স্বাধীনভাবে মুরগির বাচ্চা-খাবার ইত্যাদি কিনে মুরগি পালন করেন তাহলে লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হবেন কারণ সব কিছুই বাড়তি দামে কিনতে হবে বলে আপনার প্রতি কেজি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে অনেক। বড় আকারের খামারের মালিক হলে হয়তো লোকসান কাটিয়ে উঠা যাবে কিন্তু লাভের পরিমাণ আশাব্যঞ্জক হবার সম্ভাবনা কম। সেই বিবেচনায় খামারির কাছে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং লাভজনক না হলেও নিরাপদ।
কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর ধারণা নতুন নয়। নিত্য খাদ্যপণ্য নয় এমন অনেক শিল্পে আগে থেকেই এই পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এর প্রভাব অনেকক্ষেত্রে ইতিবাচক কারণ এর মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় কমে। তাছাড়া এমন পণ্যের নিয়মিত ভোক্তা না হওয়ায় খদ্দেরের গায়ে প্রভাব পড়ে না বললেই চলে।
খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও অনেক স্থানে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে পোল্ট্রি সহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য উৎপাদনে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর গবেষণা চলছে বেশ অনেকদিন ধরে। পোল্ট্রি খাত ছাড়াও আরও কিছু খাদ্যপণ্যে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং চলছে কিন্তু সেগুলো আকারে এখনও ছোট।
প্রশ্ন হলো – কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এ সমস্যাটা কোথায়? খালি চোখে সমস্যা নাই। কিন্তু আপনাকে প্রতিদিন কিনতে হয় এমন পণ্যের ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন শিল্প ভয়ংকর, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে আইন ক্ষমতাবানদের হাতের মুঠোয় থাকে। ‘সিন্ডিকেট’ যেখানে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য সমস্যা, যেখানে প্রান্তিক ক্রেতার স্বার্থ রক্ষার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না এবং যেখানে সবাই ‘শক্তের ভক্ত কিন্তু নরমের যম’, সেখানে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর উপকারভোগীর চেয়ে ক্ষতিগ্রস্থের সংখ্যা অনেক বেশি হবে।
পোলট্রি ব্যবসায়ীরা যে কাজ শুরু করে দিয়েছে সেই একই পথে আরও ব্যবসায়ীরা হাঁটবে – এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন। নিয়মিত পত্রিকা পড়লে জেনে থাকবেন – বাংলাদেশের বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো ইতোমধ্যেই চাল উৎপাদনের জন্য হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, চালের বাজারের প্রভাবক হয়ে উঠছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। নওগাঁ-দিনাজপুরের মতো জায়গাগুলোতে বিশাল বিশাল মিল স্থাপন করতেছে তারা। এই মিলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য তারাও কৃষকের সাথে চুক্তিতে যাবে। ধানচাষীরাও বাধ্য হবে – কারণ গত কয়েক দশকে কৃষি ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন ঘটে গেছে যে বীজ ধান থেকে শুরু করে সব উপকরণের জন্য তৃতীয় পক্ষের উপরই নির্ভর করতে হয়।
পাকিস্তান আমলে বাইশ পরিবার খুব বিখ্যাত ছিল। তারা ছিল ধনী ব্যবসায়ী গ্রুপ যারা পাকিস্তানের ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো। এদের মধ্যে দুটি পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে সুপরিচিত – এ কে খান গ্রুপ এবং ইস্পাহানী গ্রুপ। আমার আশংকা – স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করবে পঞ্চাশ-ষাট বা একশটি গ্রুপ অব কোম্পানীজ। সারাদিনের খাদ্যতালিকায় দেশের বড় বড় গ্রুপগুলোর অবস্থান কোথায় সেটা একটু ভাবলেই স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। আশংকা সত্যি কিনা সেটা হয়তো আর দশ বছরের মধ্যেই টের পাওয়া যাবে।
আমাদের ভবিষ্যৎ গুটিকয়েক পরিবারের মুষ্টিতে আবদ্ধ হবার পেছনে প্রধান কারণ দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ। দেশে প্রধান বিরোধী দল বলে কিছু নেই, যা আছে তারা কোনঠাসা। সরকারি দল একাধিক মেয়াদে ক্ষমতায় উপবিষ্ট থাকায় গণতন্ত্রকে বইয়ের পাতায় ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। কে না জানে – রাজনীতি আর ব্যবসা হাত ধরাধরি করে চলে।
বড় গ্রুপগুলোকে আরও বড় করে তুলছে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যাংকগুলো ব্যক্তিস্বার্থে ব্যাংকিং নীতি ও প্রচলিত বিধি উপেক্ষা করে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋণ সুবিধা দেয়, অথচ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের গলা টিপে ধরে। এমনকি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদেরকে উদ্দেশ্য করে দেয়া বিভিন্ন আর্থিক সুবিধাও বড় সকল প্রতিষ্ঠানগুলো আইন ও নীতিমালার নানা রকম ফাঁকফোকর দুর্বলতা ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে ভোগ করে। তেলা মাথায় তেল দেয়ার এই প্রথা চলতে থাকলে ভোক্তাদের ভবিষ্যতকে তারা হাতের মুঠোয় বন্দী করবে – এ আর অসম্ভব কি?
আমাদের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সংকটময়। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোন রাস্তা আমি দেখি না।