ডিএসএলআর এ তোলা ছবি কিংবা ড্রোন ক্যামেরায় তোলা ভিডিও দেখে নয়, নেত্রকোনাকে আমি ভালোবেসেছিলাম সোমেশ্বরীর টলটলে স্বচ্ছ জলের কারণে।
বহুদিন ধরেই নেত্রকোনা ভ্রমণ, মানে বিরিশিরিতে সোমেশ্বরী নদীর সাথে পুনরায় সাক্ষাতের আগ্রহ বোধ করছিলাম, কিন্তু নানা কারণে সে সুযোগ হয়ে উঠছিল না। তাই যখন জানলাম রবিবারে মেয়ের স্কুল ছুটি তখন নেত্রকোনা বিরিশিরিতে বেড়িয়ে আসার চিন্তাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আর রুহুল কাদের যখন নেত্রকোনা ভ্রমণে সম্মতি দিল তখন সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হয়ে গেলো এবং রাত সাড়ে দশটার সিদ্ধান্তে পরদিন সকালে আমরা নেত্রকোনা রওয়ানা করলাম।
সম্ভবতঃ ২০১২ সালে আমি প্রথমবারের মতো নেত্রকোনার দূর্গাপুর এবং বিরিশিরিতে যাই। এক দশক সময়ে অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। তখন আমি গিয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে। এবার পরিবার ও বাচ্চাদের নিয়ে। সাথে আছে রুহুল কাদের ও তার স্ত্রী রিয়া। স্বাভাবিকভাবেই এবারের যাত্রায় পূর্বের অভিজ্ঞতার সাথে বর্তমানের অভিজ্ঞতার তুলনা চলেছে। এখানেও বোধহয় তার ব্যতিক্রম ঘটবে না।
নেত্রকোনা ভ্রমণ
নেত্রকোনা গিয়েছি দুইবার। প্রথমবার ২০১২ সালে, শেষবার ২০২৩। দুইবারের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাগুলো চারটি ভাগে প্রকাশ করেছিলাম – চীনামাটির পাহাড়ে, সোমেশ্বরী নদীতে, বঙ্গসীমান্তে শিহরিত সন্ধ্যা এবং নেত্রকোনায় জল নেই, কেবল ড্রেজার আর ট্রাক। পাঠকের পড়ার সুবিধার্থে সকল লেখাকে ছবিসহ একটি ই-বুকে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ফাইল সাইজ: ০০ মেগাবাইট।
ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন – ছবিতে অথবা এখানে
নেত্রকোনার মূল আকর্ষণ দূর্গাপুরে, যদিও সবাই বলে বিরিশিরিতে। দূর্গাপুর হলো নেত্রকোনার একটি উপজেলা, বিরিশিরি তার একটি ইউনিয়ন। বিরিশিরিতে দেখার কিছু নেই, আছে থাকার জায়গা। চীনামাটির পাহাড়, নীল পানির লেক আর সোমেশ্বরী নদী অর্থ্যাৎ প্রধান ট্যুরিস্ট আকর্ষণ সবগুলোই দূর্গাপুরে। সোমেশ্বরী নদীর উত্তর পাড়ে দূর্গাপুর, দক্ষিণে বিরিশিরি। সমস্যা হলো – বিরিশিরি বা দূর্গাপুরে পরিবার নিয়ে যাওয়ার ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। বিগত পঞ্চাশ বছরেও ছিল না। রেলপথে নেত্রকোনা গিয়ে সেখান থেকে বিরিশিরিতে আসা যায়। মহাখালী বাস টার্মিনাল হতে অল্প কিছু বাস দূর্গাপুর বা বিরিশিরিতে যায় বটে, সেগুলোয় দিনের বেলা প্রায় ছয় ঘন্টা সময় লেগে যায়। এ কারণে সাধারণত নাইটকোচেই যাওয়ার পরামর্শ দেয় অভিজ্ঞ ভ্রমণকারীরা। প্রথমবার আমিও নাইটকোচেই গিয়েছিলাম।
কিন্তু এবার জানলাম ময়মংসিংহ গিয়ে সেখান থেকে বিরিশিরি-দূর্গাপুরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাওয়া যায়, সময়টাও অপেক্ষাকৃত কম লাগে। আমরাও সেভাবে গেলাম। মহাখালী থেকে মাসকান্দা বাসে, সেখান থেকে ব্যাটারীচালিত অটোরিকশায় শম্ভুগঞ্জ, সেখান থেকে সিএনজিতে জনপ্রতি ১৭০ টাকা ভাড়ায় বিরিশিরি। ফিরেছিও একইভাবে, তবে তখন সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা।
মৌসুমী গেস্ট হাউজ
যেহেতু হঠাৎ সিদ্ধান্তে যাত্রা, সেহেতু থাকার কোন ব্যবস্থা আগে থেকে করার সুযোগ হয়নি। এবং, যেহেতু সময়টা শীতের শুক্রবার এবং পরিবার নিয়ে যাচ্ছি, তাই আবাসনের ঘাটতি থাকার সম্ভাবনা আছে এবং আগে থেকেই আবাসনের ব্যবস্থা করে নেয়া উচিত। সুতরাং, ময়মনসিংহ রুটের বিখ্যাত এনা বাসে বসে গুগল ম্যাপস ঘেঁটে বিরিশিরিতে থাকার কি কি ব্যবস্থা আছে তার তালিকা তৈরি, ফোন করে দুটো রুম ফাঁকা আছে কিনা খোঁজ করতে লাগলাম। কপাল মন্দ, কোথাও ফাঁকা নেই, কেবল মৌসুমী গেস্ট হাউজ থেকে জানালো – এগারোটার দিকে জানানো যাবে কারণ বর্তমান বোর্ডার এখনও ঘুমাচ্ছে।
প্রথমবার এসে ইয়াং ওমেন ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশন (ওয়াইডব্লিউসিএ) এর গেস্ট হাউজে উঠেছিলাম। এটি ছাড়া আরেকটি প্রতিষ্ঠান ইয়াং মেন ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশন (ওয়াইএমসিএ) এর গেস্ট হাউজে থাকা যেতো। এছাড়া কিছু হোটেল ছিল কিন্তু বাধ্য না হলে কেউ ওগুলোয় থাকতো না। এবার দেখলাম বিরিশিরিতে বেশ কতগুল থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কয়েকটি কৃষি খামারেও থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ক্যাম্পিং করা এবং তাঁবু খাটিয়ে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে কারও কারও। মজার ব্যাপার হলো – নদী বাংলা গেস্ট হাউজ নামে নতুন একটি হোটেল হয়েছে যাদের এসি ও নন এসি রুম আছে। তাদের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হলো – এডাল্টদের জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া রুম ভাড়া দেয়া হবে না। অবাক তো হয়েছিই, বিরক্তও হয়েছি।
ঘন্টা খানেকের চেষ্টার পরেও যখন কোন ব্যবস্থা হলো না তখন মৌসুমী গেস্ট হাউজ থেকে ফোন করে জানালো – দুটি রুম ফাঁকা হবে, ভাড়া আটশ টাকা। এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম।
ওয়াইএমসিএ এবং ওয়াইডব্লিউসিএ এর মাঝখানে মাত্র চারটা রুম নিয়ে মৌসুমী গেস্ট হাউজ। পাকা ঘর। লাগোয়া টিনের ঘরে বাচ্চাদের নিয়ে যে গারো ভদ্রমহিলা থাকেন তিনিই গেস্ট হাউজ পরিচালনা করেন। ছোট্ট জায়গা, ঘর ছাড়া আর জায়গা নেই। রুমগুলো বড়। একটা ডাবল আর একটা সিঙ্গল খাট প্রতি রুমে। আহামরি কিছু নয়, তবে পরিচ্ছন্নতা আর আতিথেয়তার কারণে পছন্দ হয়ে গেল।
ছোট্ট একটু সমস্যা আছে – টয়লেটে বদনা নেই, মগ দিয়ে কাজ সারতে হয়। অন্ততঃ একটি রুমের খাটের অবস্থান এমন যে পশ্চিমদিকে পা দিয়ে শুতে হয়। বদনা না থাকা আর পশ্চিমমুখী খাটের কথা ওয়াহিদ সুজন ভাই আগেই বলে রেখেছিলেন। উনি উকিল মুন্সীকে নিয়ে গবেষণার সূত্রে নেত্রকোনায় বেশ কয়েকবার এসেছেন। উকিল মুন্সীর বাড়ি এই নেত্রকোনাতেই।
শুয়োর
মৌসুমী গেস্ট হাউজেই নেত্রকোনার প্রথম শুয়োরটা দেখলাম। পেটে দড়ি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। দিদি জানালেন – গারো বিয়ে উপলক্ষ্যে কেনা হয়েছে শুয়োরটি, দাম পড়েছে বিশ হাজার টাকা। দুই দিনে আরও বেশ কয়েকবার শুয়োর দেখেছি। পাহাড়ের দিকে গেলে গারো বাড়ি দেখা যায়। সেখানে বাড়ির সামনে শুয়োর বাঁধা দেখলাম কয়েক জায়গায়।
নেত্রকোনা থেকে ফিরে আসার জন্য যখন গেস্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে এসেছি তখন একটা বেশ বড়সড় শুয়োরকে ভ্যানের উপরে রেখে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। শুয়োরটা মৃত। আমি জিজ্ঞেস করলাম – মরে গেছে? ওরা বলল, মরে নাই, মেরে এনেছি। উত্তরে আমি একটু অবাক হলাম। কারণ শুয়োরের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নেই, তাহলে মারলো কিভাবে?
উত্তর পেয়েছি সিএনজি চালকের কাছ থেকে। তিনি জানালেন, গারোরা শুয়োরের হৃদপিন্ড বরাবর লোহার শিক ঢুকিয়ে দেয়, তাতেই মরে যায় শুয়োর (সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে)। মৃত শুয়োরকে ফুটন্ত পানিতে কিছু সময় ডুবিয়ে রাখলে চামড়ার পশমগুলো নরম হয়ে যায়। তখন টেনে টেনে ছিড়তে হয়। কালো শুয়োর তখন সাদা হয়ে যায়। তারপর মৃত শুয়োরটাকে আগুনে পোড়ানো হলে গায়ের রঙ হয় বাদামী। এবার শরীরের চামড়া ছড়িয়ে মাংস বের করে আনা হয়, কেটে টুকরো করা হয়। তারপর নানা রকম মশলা মিশিয়ে রান্না হয়।
গারোরা মাংসের জন্য শুয়োরের উপর নির্ভরশীল। এজন্য অনেকে ঘরেই শুয়োর পালে। উৎসবে শুয়োর খাওয়া হয়। মোরগও সাধারণত উৎসবের খাবার। আর উৎসব মানেই চু এর স্রোতস্বিনী। চু হলো এক ধরণের মদ যা সাধারণত চাল, গম, ভুট্টা আর এক ধরণের আলু (গারো আলু নামে পরিচিত) মিশিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই মদ তৈরি করা হয়। গারোদের যে কোন অনুষ্ঠানেও চু পান করা হয়। এটি তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমাদের বাচ্চাদের জন্মের পরে মধু দেয়ার প্রচলন আছে, গারোরা মধুর পরিবর্তে চু-তে আঙ্গুল ডুবিয়ে শিশুর মুখে দেয়। এতে বোঝা যায়, চু তাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
আগেরবার গেস্ট হাউজেই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এখানে সেরকম ব্যবস্থা ছিল কিন্তু আমরা স্থানীয় হোটেলেই খেয়েছি। সুজন ভাই আগেই বলেছিল, খেতে গিয়ে উনার কথার সত্যতা টের পেলাম। শুটকী, গরু, কালাভুনা, কলিজা, ভর্তা, ডাল – কোন খাবারেই স্বাদ পাওয়া গেল না বরং অনাবশ্যক ও মাত্রাতিরিক্ত ঝালে মুখ পুড়ে গেলো। বাচ্চারা খেতে পারলো না। খাবার হোটেল হাতে গোনা, তার তিনটিতে চারবেলা খেয়েছি। একই রকম – আলমগীর হোসেন ভাই ভাই রেস্টুরেন্ট সামান্য ব্যতিক্রম হওয়ায় সেখানে দুই বেলা খাওয়া হলো। সকল তরকারির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো – ওগুলো বরফের মতো ঠান্ডা। সকাল-দুপুর-রাত যে সময়েই হোক না কেন। আমার কপাল ভালো – রাতে খিচুড়ি আর ডিম ভাজি খেয়েছি – দুটোই চুলার উপর থেকে এনে পরিবেশন করায় ঠান্ডা খেতে হয়নি।
চা এর কথা বলে নেই। কোন রেস্টুরেন্টেই চায়ের ব্যবস্থা নেই। তবে চাইলে এনে দেয়। ওয়াইডব্লিউসিএ-এর রাস্তায় প্রবেশের আগে বাম কোনায় একটা চায়ের দোকান আছে – গরুর দুধের চা পাওয়া গেল। অপেক্ষাকৃত ভালো। ওখানে মালাই বিক্রি হচ্ছিল – প্রতি কাপ পঞ্চাশ টাকা। রাতে খেতে এসে দেখি শেষ, সকালে গিয়ে দেখি তৈরি হয়নি। ফলে মালাই চেখে দেখার সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হতে হলো।
সোমেশ্বরী নদী
সোমেশ্বরী নদী দেখবো বলে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে ছিলাম – খাওয়ার পর তাই সেদিকেই রওয়ানা হলাম। দশ বছরে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। তখন মোটরসাইকেলের পেছনে বসে যেতে হতো। আমরা হেঁটে গিয়েছি-ফিরেছি। এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ছড়াছড়ি। বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির সাথেই ময়মনসিংহ বাসস্ট্যান্ড, আর সেখান থেকেই অটো রিজার্ভ করে চীনামাটির পাহাড়ে যাওয়া যায়। বারোশ টাকা চাইল, ব্রিজের জন্য নাকি দুইশ টাকা দিতে হবে। ধূলোর রাজ্যে গোড়ালি পর্যন্ত ডুবিয়ে আমরা হেঁটেই চললাম।
নদীর তীরে গিয়ে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। কোথায় সোমেশ্বরী নদী? কোথায় সেই চিকচিকে বালুময় তীর? কোথায় স্বচ্ছ স্ফটিক জল? কিচ্ছু নেই। যেদিকেই তাকাই কেবল ড্রেজার আর ট্রাক। প্রচন্ড শব্দে ড্রেজার চলছে, নদী থেকে বালু উঠছে ট্রাকে। সেই ট্রাক সারি বেঁধে উঠে যাচ্ছে সড়কে।
সবচেয়ে কষ্ট লাগলো নদীর অবস্থা দেখে। মাটি আর বালু ফেলে নদীর বুক চিড়ে রাস্তা বানানো হয়েছে। সেই রাস্তায় ধূলো উড়িয়ে যাচ্ছে ট্রাক। সেই রাস্তা ধরেই চলছে মানুষ, গরু-ছাগল। নদীতে প্রবাহমান কোন পানি নেই। জায়গায় জায়গায় আবদ্ধ পানি। বালু তুলে জমা করে রাখায় মরুভূমির মত দেখাচ্ছে। নদীর অপর প্রান্তে এক-দেড়শ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি কাঠের সেতু তৈরি করা হয়েছে, সেখানে কতগুলো লোক চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে আছে। হেঁটে পারাপারে জনপ্রতি পাঁচ টাকা করে নিচ্ছে। অটোরিকশা গেলে দুইশ টাকা।
এক দশক আগে যখন এসেছিলাম তখন ঠিক এই জায়গাটায় ছিল স্বপ্নের মতো চমৎকার এক নদী। নদীর পানি টলটলে স্বচ্ছ, ঠান্ডা, বয়ে যাচ্ছে কুলকুল করে। পা ডুবিয়ে দাঁড়ালে মন ভিজে যায়, শীতল হয়। নদীতে খেয়া ছিল। জনপ্রতি চার বা পাঁচ টাকায় নদী পার করে দেয়। আমরা অবশ্য হেঁটেই পার হয়েছিলাম, সর্বোচ্চ গভীরতা কোমড় পর্যন্ত। ফেরার সময় এই নদীতেই গা ডুবিয়ে শুয়ে ছিলাম, গোসল করেছি দীর্ঘ সময় নিয়ে। রাতে ফিরে এসেছি বালুময় সৈকতে, চাঁদের আলোয় নদীর পাড়ে হেঁটেছি, বসে থেকে জোৎস্না দেখেছি। সেই একই নদীর এই দুর্দশা সহ্য করা যায় না।
অবশ্য নদীর এই কদাকার রূপ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি বিরিশিরিতে পৌঁছার সময়েই। রাস্তায় প্রায় শ’খানেক ট্রাক দেখেছি। বালু কেনা-বেচার হাট দেখেছি ডজনখানেক। রাস্তায় ধূলার পুরু স্তর আর ঢেউ খেলানো রাস্তা দেখে বুঝেছি ভারী সব ট্রাকের চলাচল হলো এর কারণ।
বালুখেকোরা সোমেশ্বরীকে কিভাবে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে তা নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকায় একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল গেল বছরের জানুয়ারিতে। বাংলাদেশ সীমান্তের এক কিলোমিটার থেকে শুরু করে সাড়ে চার কিলোমিটার ভাটিতে অন্ততঃ পাঁচটি বালুমহাল ঘোষণা করা হয়েছে। লক্ষ থেকে থেকে শুরু করে কোটি টাকায় সেই বালুমহালের ইজারা নিয়েছেন এবং বছর বছর চুক্তি নবায়ন করছেন স্থানীয় সরকারদলীয় নেতারা। তারা জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা ও চুক্তি ভঙ্গ করে পরিবেশ দূষিত করে এবং শত শত ড্রেজার ব্যবহার করে দিনরাত নদী থেকে বালু তুলছে। সাথে উঠছে পাথর ও কয়লা। ড্রেজার ব্যবহারের কারণে নদীর ৫০-৮০ ফুট গভীর থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে। এভাবে দৈনিক উত্তোলিত বালুর পরিমাণ পাঁচ লাখ ঘনফুট।
নদীর অপর পাড়ে অনেকগুলো অটোরিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। এখানেও সিন্ডিকেট। রিজার্ভ নিতে হলে সিরিয়ালের প্রথম অটোকেই ভাড়া নিতে হবে৷ ভাড়া দরকষাকষি করে দিচ্ছেন যিনি তিনি আবার অটোচালক নন। সেখান থেকে সাড়ে পাঁচশ টাকায় পাঁচটি স্পট ঘুরিয়ে আনার জন্য একটি অটো ভাড়া নেয়া হলো।
এই রাস্তা সোজা চলে গেছে বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্প পর্যন্ত। পিচঢালা রাস্তা। তবে এখানেও প্রচুর ধূলা। শীতকালে ধূলা উড়বেই। তার উপর এ অঞ্চলটা একটু রুক্ষ এবং পাশেই নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। শান্তির ব্যাপার হলো – এই রাস্তায় বালুর ট্রাক চলছিল না।
চীনামাটির পাহাড়
রাস্তা থেকে বামদিকে গ্রামের ভেতরে চীনামাটির পাহাড় এবং নীল পানির লেক। বেশ জমজমাট অবস্থা। অনেক মানুষ এসেছে বেড়াতে। পিকনিক বাস দেখলাম কয়েকটা। পর্যটন কর্পোরেশনের একটা ছোট্ট অফিস বিল্ডিং দেখা গেলো। সেখানে অবশ্য লোক ছিল না। সম্ভবত শুক্রবার ছুটির দিন বলে। তবে সেখানে পর্যটন কর্পোরেশনের কার্যক্রমের কোন প্রমাণও পেলাম না। তথ্য সংক্রান্ত বা নির্দেশনা বিষয়ক কোন সাইনবোর্ড দেখা গেলো না। পিকনিক দলের ফেলে যাওয়া ওয়ান টাইম প্লেট, খাবারের উচ্ছিষ্ট, প্যাকেট ইত্যাদির কারণে পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা হয়ে আছে।
যেহেতু পর্যটনস্থানে কোন তথ্য চোখে পড়ল না, তাই বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে চীনা মাটির পাহাড়ের ইতিহাস জেনে নিতে হলো। সংক্ষেপে উপস্থাপন করা যাক। চীনা মাটির পাহাড়কে সাদা মাটির পাহাড়ও বলা হয়। বাংলাদেশে চীনা মাটির অস্ত্বিত্ব বা খনি রয়েছে এমন জায়গার মধ্যে নেত্রকোনার বিজয়পুর ও গোপালপুর অন্যতম। এছাড়া শেরপুরের নালিতাবাড়ী, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, দিনাজপুরের মধ্যপাড়া ও বড়পুকুরিয়া, নওগাঁর পত্নীতলায় সাদা মাটির অস্ত্বিত্ব রয়েছে। সম্ভবতঃ নেত্রকোনার বিজয়পুরের চীনামাটির খনি সর্ববৃহৎ।
১৯৫৭ সালে বিজয়পুরের খনি থেকে সাদা বা চীনা মাটির উত্তোলন শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন খনিজ সম্পদ ব্যুরো জানিয়েছিল, খনিতে যা সাদা মাটি মজুদ রয়েছে তার পরিমাণ ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন যা দিয়ে ৩০০ বছরের চাহিদা মেটানো সম্ভব। প্রায় নয়টি কোম্পানী এখান থেকে চীনামাটি উত্তোলন করছে – এমন তথ্য একাধিক জায়গায় পেলেও সেরকম কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
চীনা মাটি বা চায়না ক্লে বলা হয় কেন? এই প্রশ্ন আমার মাথায়ও এসেছে। স্পষ্ট উত্তর নেই। ধারণা করা হয়, চীন দেশের মানুষ প্রথম এই মাটি ব্যবহার শুরু করে। মূলত সিরামিকের জিনিসপত্র তৈরিতে এই মাটি ব্যবহার করা হয়।
বিজয়পুরের চীনা মাটির পাহাড়ের তুলনায় দর্শনীয় স্থান হলো নীল পানির লেক। পাহাড় কেটে সাদা মাটি উত্তোলনের কারণে সৃষ্ট গর্তে জমা পানিই এখনকার বিখ্যাত নীল পানির লেক। লেক এবং লেকের পার্শ্ববর্তী তীর ও পাহাড় দেখলেই বোঝা যাবে – এই পুকুর ও মাটি স্বাভাবিক নয় এবং, সম্ভবত, রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি ব্যাপক। পাহাড়ে গাছপালা বলতে তেমন কিছু নেই। কোন পাখি দেখা যায় না এবং, আমার ধারণা, পুকুরের পানি বিষাক্ত হওয়ায় কোন মাছ নেই।
জমে থাকা পানি মনে কোন ছাপ ফেলল না। আগেরবারও ফেলেনি। লেকের নাম নীল পানির লেক। ওয়েব দুনিয়ায় যা ছবি পাওয়া যায় তার সবই নীল৷ কিন্তু আমার সবুজ ছাড়া আর কোন রঙ চোখে পড়ল না। আমি বর্ণান্ধ নই, তবে খালি চোখে কেউ নীল পানি দেখেছে বলেও শুনিনি। ডিএসএলআর দিয়ে দেখার দুর্লভ ক্ষমতা আর কয়জনের থাকে!
এবারে চীনা মাটির পাহাড়ে আরও একটি পার্থক্য চোখে পড়ল। এখানে বেশ কিছু দোকান বসেছে। বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পের পাশে পাহাড়ের পাদদেশেও দোকান বসেছে। এসব দোকানে দেশে তৈরি প্লাস্টিকের বিভিন্ন দ্রব্যের পাশাপাশি নানা রকমের কসমেটিক্স, চকলেট ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। ভারত থেকে আনা হয়েছে – এমনটাই জানালো দোকানদাররা। সত্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে কিছু কেনার সাহস হলো না। তবে কিছু চকলেট আচার কিনতে হলো এবং মুখে দেয়ার পর বুঝতে পারলাম – ঝুঁকি না নেয়াই উচিত কাজ হয়েছে, ঢাকায়ও এত নিম্নমানের জিনিস পাওয়া যায় না।
বিজয়পুর পাহাড়
আমাদেরকে চীনামাটির পাহাড় থেকে বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যেতে যেতে অটো ড্রাইভার জানালো, ওখানে আরও বেশি দোকান আছে, মালও ভালো। তার পাশে বসে টুকটাক কিছু আলাপ করতে চেষ্টা করলাম। কথা বেশিদূর এগুলো না। তার ভাষা পুরোটাই নেত্রকোনার আঞ্চলিক, সব কথা বুঝতে কষ্ট হয়। যা কিছু বুঝতে পারলাম তা থেকে বুঝলাম সে সরকারদলের কঠোর সমর্থক এবং দুর্গাপূরের সাবেক চেয়ারম্যান সুব্রত সাংমার অনুসারী। সুব্রত সাংমা চেয়ারম্যান থাকাকালেই বিজয়পুর পর্যন্ত এই রাস্তা পাকা হয়েছে। চেয়ারম্যান গারো হলেও অনেক ক্ষমতাবান ছিল। বর্ডারের দিকে বাড়ি হওয়ায় বর্ডারের ওপার থেকে মালামাল আনতে কোন সমস্যা হয় নাই। চেয়ারম্যানকে কিছুদিন আগে মেরে ফেলেছে বিএনপি সমর্থক বর্তমান চেয়ারম্যান। পত্রিকা ঘেঁটে দেখলাম – ঘটনা সত্য – গত ৮ অক্টোবর সুব্রত সাংমা মারা গেছেন।
বিজয়পুর সীমান্তে বিজিবির ক্যাম্প। তার একদিকে সোমেশ্বরী নদী, অন্যদিকে বিজয়পুর পাহাড়। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল – আমরা নদীর দিকেই গেলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলেই কিনা জানি না, নদী থেকে ড্রেজারের বিকট শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। নদীর ঘাটে গিয়ে মন জুড়িয়ে গেলো। দেশের সীমানার সাথেই হওয়ায় এখানে বালু উত্তোলনের কার্যক্রম নেই। প্রায় এক যুগ আগে সোমেশ্বরীর যে রূপ দেখে আমি বিমোহিত হয়েছিলাম, সেই রূপ যেন এখানে পাওয়া গেলো – শান্ত, স্থির। একটু দূরে বালুচর। আরও দূরে, নদীর ওপারে, ভারতের সীমানা।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। নদীতে পা ডুবানোর ইচ্ছা পূরণ করা হলো না।
★★★★★
দূর্গাপুরের গারোরা
কোথাও বেড়াতে গেলে ভোরে সূর্য উঠার আগেই ঘুম থেকে উঠতে হয়। এর ফলে সময়ে বরকত পাওয়া যায়, মনটাও চনমনে থাকে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার – এই সময়ে পৃথিবীর যে সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায় তা দিনের বাকী সময়ে সম্ভব হয় না।
পরদিন ভোরে বাচ্চাদেরকে ঘুমে রেখে আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। রুহুল কাদের তখনও ঘুমে, ডেকে সাড়া পেলাম না। মূল রাস্তায় না উঠে আমরা বরং গ্রামের ভেতরের দিকে এবং রিকশা চলাচলের রাস্তা ছেড়ে মেঠোপথ ধরলাম।
এই অঞ্চলে গারোদের সংখ্যা অনেক। বইপত্র অনুসারে গারোদের পাশাপাশি হাজংরাও থাকে এখানে, আমি পার্থক্য করতে পারি না, তাই হাজং গোত্রের কারও সাথে দেখা হয়েছে কিনা নিশ্চিত করে বলতেও পারি না।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা গেলো, কয়েক শতাব্দী পূর্বে এই অঞ্চলে গারো সহ বিভিন্ন উপজাতির লোকেরা বাস করতো যাদের মধ্যে গারোরা ছিল সংখ্যায় বেশি এবং এই অঞ্চলের রাজাও ছিল গারো। কামরূপ কামাখ্যা থেকে সোমেশ্বরী পাঠক নামে একজন ব্রাহ্মণ এ অঞ্চলে এসেছিলেন পাঁচশ বা সাতশ বছর আগে। তারপর এই অঞ্চলের রূপে মুগ্ধ হয়ে এবং তৎকালীন গারো রাজা বৈশ্যকে পরাজিত ও নিহত করে তিনি এই অঞ্চল দখল করে নেন যা পরবর্তীতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয়শ বছর তার বংশধরদের দ্বারা শাসিত হয়েছে।
মুঘল সম্রাট আকবর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সোমেশ্বরী পাঠকের বংশধর তৎকালীন রাজা রঘুনাথ সিংহ সম্রাট আকবরের সাথে একটি চুক্তি করেন এবং চুক্তি মোতাবেক রাজা মানসিংহের পক্ষে বিক্রমপুরের চাঁদ রায়, কেদার রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন। সে সময় রঘুনাথ অষ্টধাতুর এক দূর্গামূর্তি নিয়ে এসে রাজমন্দিরে স্থাপন করেন। আর এভাবেই সু-সঙ্গের সাথে দূর্গাপুর যোগ করে এর নামকরণ করা হয় সুসং দূর্গাপুর।
ইউক্যালিপটাস
এই সুসং দূর্গাপুরেই বেড়াতে এসে ভোরবেলা গ্রামের দিকে হাঁটতে বেরিয়েছি আমরা দুজন। কারও বাড়ির সামনে, কারও বাড়ির পেছনে কিংবা দুই বাড়ির মাঝের পায়ে চলা পথ পেরিয়ে বিশাল খোলা প্রান্তরে উপস্থিত হলাম। ধান উঠে গেছে, কিন্তু পরের চাষাবাদের কাজ শুরু হয়নি। মাঠ খটখটে শুকনো। ক্ষেতের মধ্যেই কেউ একটা বাড়ি বানাচ্ছে। তার আশেপাশে দুয়েকটা লোক দেখা গেলো। ঐ দূরে যে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে সেটা দিয়ে উত্তরে কিছুদূর গেলে বামে সোমেশ্বরী নদী পড়বে, তাই সেদিকেই হাঁটতে শুরু করলাম।
গতকাল থেকে বেড়াচ্ছি কিন্তু এবার খেয়াল হলো ভোরবেলায় গ্রামে যতরকম পাখ-পাখালি দেখা যায় তার কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। এখন মাঠে আছি, শীতের দিন, কিন্তু পাখি নেই। কিছুক্ষণ আগে বাড়ির মধ্যে ছিলাম, গাছপালা ছিল, তাও পাখি দেখিনি। অথচ ভোরই হলো পাখি দেখার উপযুক্ত সময়।
রহস্যের সমাধান মিলল রাস্তায় উঠার পর। রাস্তার দুধারেই ইউক্যালিপটাস গাছ। মনে পড়ল – গ্রামেও এই গাছ দেখেছি, বিজয়পুরেও। সিএনজিতে বিরিশিরি আসার পথেও এই গাছ দেখেছিলাম। বহু বছর আগে, রাজনৈতিক ডট কম নামে মোহাম্মদ আরজুর সম্পাদনায় প্রকাশিত একটা অনলাইন ম্যাগাজিনে আমার কয়েকটা লিখা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানেই প্রকাশিত অন্য কারও একটা লেখা পড়ে বাংলাদেশে ইউক্যালিপটাস গাছের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জেনেছিলাম। সংক্ষেপে কিছুটা বলা যাক।
ইউক্যালিপটাস এই অঞ্চলের গাছ নয়। এই গাছ খুব দ্রুত লম্বা হয় এবং মোটামুটি মানের কাঠ পাওয়া যায়। বিদেশী এই গাছের বিস্তার লাভ করার পেছনে মূল কারণ বিদেশী অর্থসাহায্য। আশির দশকে সামাজিক বনায়নের নামে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও ইউএসএআইডি এর অর্থায়নে এই দেশে ইউক্যালিপটাস ও অ্যাকাশিয়া বা আকাশমনি ও পাইন গাছের চারা রোপন শুরু হয়। এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ বন ধ্বংস করে বিদেশী এইসব গাছ লাগানোর ক্ষতিকর প্রভাব আবিষ্কার করতে অবশ্য দুই আড়াই দশক লেগে গেছে।
ইউক্যালিপটাস গাছের শেকড় মাটির ২০-৩০ ফুট গভীরেও প্রবেশ করে এবং এই শেকড় দিয়ে প্রতিটি গাছ দৈনিক ৩০-৯০ লিটার পানি শোষণ করে। ফলে, এই গাছের আশেপাশে অন্যান্য ফলজ ও বনজ গাছ টিকে থাকতে পারে না, জমিতে মরূকরণ ঘটে। আরও ভয়ানক হলো, এই গাছ অক্সিজেন গ্রহণ করে ও বিষাক্ত নাইট্রোজেন ত্যাগ করে। সম্ভবত এ কারণে ইউক্যালিপটাস গাছের আশেপাশে পাখি বাসা বানায় না। উত্তরবঙ্গে এই গাছের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। ওইসব অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া ও পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে এই গাছকে দায়ী করা হয়। পরিবেশের উপর এইসব ক্ষতিকর প্রভাবের কারণেই ২০০৮ সালে ইউক্যালিপটাস গাছের চারা উৎপাদনকে নিষিদ্ধ করা হয়। তা সত্ত্বেও গাছের বিস্তার কমেনি।
যাহোক, রাস্তায় উঠে আসার পর পাখি দেখার আশা যেমন ছাড়তে হলো, নদীতে বেড়ানোর ইচ্ছাও বাদ দিতে হলো। যে রাস্তায় উঠেছি সেটাকে প্রথমে মাটির রাস্তা বলে মনে হলেও পরে আবিষ্কার করলাম – কোন একসময় এটা পিচ রাস্তা ছিল। একের পর এক বালুবাহী ট্রাক যাওয়ার কারণে রাস্তার আসল চেহারা হারিয়ে গেছে। যে রাস্তাটি নদীর দিকে গিয়েছে সেদিক দিয়েই ট্রাক আসছে, ভোরবেলায় ধূলোয় মাখামাখি হবার ইচ্ছা ছিল না। গ্রামের দিকেই ফিরলাম।
এদিকটায় খ্রীস্টানদের আধিক্য রয়েছে। আমরা একটা ক্যাথলিকদের সমাধিস্থান দেখলাম। যতটুকু জানি, এ অঞ্চলের গারো উপজাতির প্রায় শতভাগ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। উনিশ শতকের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিগণ ব্যপকভাবে খ্রীস্টধর্ম প্রচার শুরু করেন। এছাড়া ক্যাথলিক মিশনারিগণ প্রচারকার্য শুরু করেন ১৯০৯ সালের দিকে। এই এলাকায় মিশনারিদের প্রচুর সামাজিক কাজও রয়েছে। এক দশক আগে এসে দেখেছিলাম অনেক বড় আয়োজনে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। এবার দেখলাম সেই কলেজের নাম ডন বাস্কো কলেজ। অনেক বড় জায়গা নিয়ে বেশ কিছু ভবন ও হোস্টেল নিয়ে কলেজটি। সদর দরজা বন্ধ ছিল, ফাঁক দিয়ে দেখলাম ভেতরের ছেলেরা হোস্টেল থেকে মাঠে নেমেছে খেলাধূলার জন্য। এছাড়া বিরিশিরি দূর্গাপুরে নানা ধরণের প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা রয়েছে যেগুলো খ্রীস্টান মিশনারিরা পরিচালনা করছেন।
দূর্গাপুর সেতু
আমাদের প্রাতঃভ্রমণ শেষ হলো। এবার যেতে চাই গোপালপুরের গারো পাহাড়ে। যেতে হবে সোমেশ্বরী নদীর উপরের সেতু পেরিয়ে। এই সেতুটা আমার বিশেষ পছন্দের। আগেরবার এসে বার কয়েক সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে নীচের নদীতে স্বচ্ছ পানির মৃদু স্রোত বয়ে যেতে দেখেছি। এবার সেরকম কিছু দেখতে পারবো না বুঝে গিয়েছিলাম। তারপরও ভাবলাম হেঁটে সেতু পার হয়ে অটোরিকশা ভাড়া করবো।
রাস্তা দেখা যাচ্ছিল না। কাদার পুরু স্তর। তার উপর দিয়ে বিশাল বিশাল ট্রাক বালু ভর্তি করে যাচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। উল্টোদিক থেকে খালি ট্রাক ছুটে আসে তীব্র গতিতে। বালিভর্তি ট্রাকগুলোর শরীর থেকে পানি ঝরতে থাকে। সেই পানিতে রাস্তা কাদা হয়ে যায়। সেই কাদা শুকানোর সুযোগ পায় না। দিনে-রাতে হাজারের বেশি ট্রাক চলে রাস্তার উপর দিয়ে।
বালুর ট্রাক থেকে পানি ঝরে কেন? নেত্রকোনার মহাসড়ক জুড়ে একটু পর পর ভুল বানানে ‘নেত্রকোণা’ সড়ক বিভাগের সাইনবোর্ডে নিষেধাজ্ঞা – ‘ভেজা বালুবাহী ট্রাক চালাবেন না।’ সেই নিষেধাজ্ঞা কেউ মানছে না। নদী থেকে বালু তুলে ভেজা অবস্থায়ই ট্রাকে করে পরিবহন করা হয়, বালু চুয়ে পানি ঝরতে থাকে সড়কে। ২০১৬ সালে ৩১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্যামগঞ্জ-জারিয়া-বিরিশিরি-দুর্গাপুর মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সড়ক এখন গাড়ি নয়, ঘোড়া চলাচলের জন্য উপযুক্ত। ভেজা বালুর কারণে ট্রাকের ওজন যায় বেড়ে। আবার প্রত্যেকটি ট্রাকের সীমানা দ্বিগুণ উঁচু করা হয়েছে কাঠ দিয়ে। এর ফলে এক ট্রাকে দুই ট্রাক সমান বালু পরিবহন করা যায়। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তৈরি রাস্তা খেয়ে ফেলেছে বালুখেকোরা।
সেতুর কাছে গিয়ে জানলাম – রাস্তা বন্ধ। সেতু ভেঙ্গে গিয়েছে ভারী বালুর ট্রাকের কারণে, তাই মেরামত চলছে। বিকল্প রাস্তা তৈরি করা হয়েছে নদীতে মাটি-বালু ফেলে। সেই রাস্তা ধরেই আমাদের পার হতে হলো। তারপর অল্পবয়সী চালকের একটি অটোরিকশা ভাড়া করে ফেললাম। এই ছেলেটার কথাবার্তা পরিষ্কার – নানা আলাপ করতে করতে আমরা গেলাম গোপালপুরে।
পাহাড়ে
নেত্রকোনা ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ এটুকুই। অটো ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গেলো গ্রামের একদম গভীরে। পাহাড় শুরু হয়েছে। মাঝে রাস্তা এঁকেবেঁকে গিয়েছে। পাহাড়ের উপর ঘরবাড়ি আছে। একটা লোক গরু নিয়ে আরও গভীরে যাচ্ছিল। অটো গাড়ির শক্তিতে অতটা গভীরে যাওয়া সম্ভব না। পায়ে হেঁটে এদিক সেদিক কিছুদূর গেলেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। পরে ড্রাইভার নিজেই রাস্তা দেখিয়ে দিল। এই পথ ধরে পাহাড়ে উঠলে পাহাড়ের অন্য দিক দিয়ে নামা যাবে গাড়ি নিয়ে সে অপেক্ষা করবে ওখানেই।
বাচ্চারা সহ সকলে মিলে পাহাড়ে চড়লাম। পর্যটকেরা হয়তো আসে এখানে, স্থানীয়রা তো আসবেই। আমাদের কপাল ভালো – কেউ নেই, কেবল আমরাই। পাহাড়টা বেশ উঁচু নয়, টিলাই বলা ভালো। কিন্তু অনেক গাছপালা, ঝোপঝাড়। ঘাসের উপর পায়ে চলা পথ। সেই পথ কখনও উঠে গেছে, কখনও নামছে। কখনও পাহাড়ের একদম কিনারা ঘেঁষে চলেছে। বাচ্চারা খুবই আনন্দ পাচ্ছিল, আমি পাচ্ছিলাম ভয়। আছাড় খেয়ে পড়লে গড়িয়ে পড়তে হবে। ঠিক পথে এগোচ্ছি কিনা সেই ভয়ও পাচ্ছিলাম। কিন্তু এক সময় দেখতে পেলাম নীচে অটোরিকশা নিয়ে আমাদের পাইলট দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম, রাস্তা একটাই, পথ হারানোর ভয় কম।
নেত্রকোনা ভ্রমণের সমাপ্তি এখানেই। সময়ের অভাব ছিল বলে পাহাড়ে আরও বেড়ানোর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ফিরতে হলো।
সোমেশ্বরীতে মুগ্ধ হয়ে ফিরে এসেছিলাম। সোমেশ্বরী মরে গেছে। পাহাড়টা ভালো লেগে গিয়েছে এবার, হয়তো এক দশক বাদে ফিরবো আবার।
বেশ ভালো লেখা। আমাকে স্মরণ করার জন্য ধন্যবাদ। … আর দুর্গাপুরের এ অবস্থা খারাপ লাগল।
আন্তরিক ধন্যবাদ প্রিয় সুজন ভাই। দূর্গাপুর আর সোমেশ্বরী নদী – দুটোর অবস্থাই অত্যন্ত করুণ। মানুষের লোভ কতটা বিধ্বংসী, সোমেশ্বরী দূর্গাপুর তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
শুয়োর মারার ঘটনা সত্য। আমি নিজের চোখে দেখেছি। লোহার শিক দিয়ে খুচিয়ে মারে।
বলেন কি! আমি ভেবেছিলাম – ব্যাটা না জেনেই বলছে।
মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আবার আসবেন 🙂
অসাধারণ লিখছেন নাজমুল ভাই 😉😉
আন্তরিক ধন্যবাদ রিমা। বাকী লেখাগুলোও পড়ার অনুরোধ .. 🙂