নবাব এলএলবি চলচ্চিত্রে পুলিশকে হেয় করার অভিযোগে পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে

anonno-mamun-shamim-mridha-nabab LLB

অনন্য মামুনের পরিচালনায় শাকিব খান ও স্পর্শিয়া অভিনীত সিনেমা ‘নবাব এলএলবি’ মুক্তি পেয়েছে সম্প্রতি। মুক্তির পর ‘নবাব এলএলবি’ ছবিতে পুলিশকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের অভিযোগে গত ২৪/১২/২০২০ তারিখ মধ্যরাতে পরিচালক অনন্য মামুনকে এবং নির্দিষ্ট দৃশ্যে পুলিশ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অভিনেতা শাহীন মৃধাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তীতে পর্নোগ্রাফি মামলায় তাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পুলিশের এই ভূমিকা নিয়ে সর্বত্র বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে। সিনেমায় পুলিশের উপস্থাপন এবং পরিচালক-অভিনেতার গ্রেফতার বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

যে দৃশ্যের মাধ্যমে পুলিশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেখানে কি ছিল? নায়িকা স্পর্শিয়া ধর্ষিত হয়েছেন এবং পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তা শাহীন মৃধা তাকে ধর্ষণ সংক্রান্ত অনেকগুলো প্রশ্ন সরাসরি করেন। পুলিশের প্রশ্ন ‘ইজাকুলেশন হইছিল? মানে মাল বের হইছিল?’ প্রশ্নের উত্তরটিই সবচেয়ে মর্মস্পর্শী যেখানে ধর্ষিতা নারী বলেছেন, ‘না হওয়া পর্যন্ত কি কোন পুরুষ থামে?’

পুলিশের প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক, কিন্তু উপস্থাপন অত্যন্ত বিকৃত। উপরের ভিডিওটি যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন, শাহীন মৃধা প্রশ্নগুলো করার সময় যে অশ্লীল ভঙ্গি করে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের সমাজে ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ এর যে প্রচলন রয়েছে তার একটি উপস্থাপন এই দৃশ্যে রয়েছে। উপস্থাপন যতই অশ্লীল হোক না কেন, এ ধরণের ঘটনার বাস্তব নজির রয়েছে। ফেনীর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত পুলিশের কাছে তাকে উত্যক্ত করার বিষয়ে জিডি করতে গেলে থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন এ ধরণের বিব্রতকর প্রশ্ন করেছিল এবং পরবর্তীতে নুসরাতের আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশ করার অভিযোগে তাকে আট বছর কারাদন্ডও দেয়া হয়।

বাংলাদেশে পুলিশের ভাবমূর্তি কখনই ইতিবাচক ছিল না। এদেশের প্রত্যেক মানুষের ভান্ডারে পুলিশ নিয়ে যদি একটি গল্প থাকে, তবে সেটি পুলিশের নেতিবাচক কর্মকান্ডেরই গল্প। স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের সিনেমায় পুলিশের ইতি ও নেতিবাচক – উভয় ধরণের কর্মকান্ডই তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বিগত ২০১৫ সালে পুলিশের পক্ষ থেকে ‘নাটক-সিনেমায় পুলিশের চরিত্রে অভিনয় ও পোশাক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ’ মেনে চলার নির্দেশনা দিয়ে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতিতে চিঠি প্রেরণ করা হয়। উক্ত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘নাটক ও সিনেমায় পুলিশের পোশাক ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করা হবে। পুলিশের ভূমিকা নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হবে না, যাতে পুলিশের প্রতি জনগণের বিরূপ ধারণা হয়।’ পুলিশ চরিত্র ব্যবহারের পূর্বে পুলিশের সদর দপ্তর থেকে অনুমতির কথাও এ সময় উল্লেখ করা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, নবাব এলএলবি সিনেমার পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেফতারের মাধ্যমে সেই চিঠির প্রয়োগ করা হয়েছে।

পুলিশের উল্লিখিত পদক্ষেপ বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপেরই একটি। সরকারী প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইত্যাদি কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেয়া সংক্রান্ত নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে একটি আইন পাশ করে প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং এই আইনের ইতিবাচক প্রয়োগের তুলনায় নেতিবাচক প্রয়োগের উদাহরণই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সুতরাং, পুলিশ কর্তৃক বিধিনিষেধ আরোপ করা এবং তা ভঙ্গ করার অভিযোগে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে গ্রেফতার করার ঘটনার মধ্যে নতুন কিছু নেই।

ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ অবতারনা করা যেতে পারে। যে দৃশ্যের জন্য অনন্য মামুন এবং শাহীন মৃধা জেলে অন্তরীন, সে দৃশ্যটি মৌলিক নয়, ভারতীয় সিনেমা থেকে চুরি করা। ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সেকশন ৩৭৫’ নামক সিনেমায় ১৪ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড থেকে পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিতাকে স্পর্শকাতর প্রশ্ন করার দৃশ্যটি রয়েছে। সিনেমাটি মুক্তির আগেই ট্রেলারে এই দৃশ্যের একটি অংশ উপস্থাপন করা হয়েছিল। এর ভিত্তিতে জনৈক ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত কর্তৃক সিনেমার প্রধান অভিনেতা অক্ষয় খান্না এবং প্রযোজকদেরকে আদালতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য, এ বিষয়ে শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অনন্য মামুন একজন চোর এবং ধান্দাবাজ হিসেবে স্বীকৃত। বিএফডিসি-তে পদার্পনের পর থেকে একের পর এক নেতিবাচক কর্মকান্ডের জন্য অনন্য মামুন সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। তাকে পরিচালক সমিতি থেকে বহিস্কার করা হয়েছে, নিজ নামে সিনেমা পরিচালনা করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, আইনের ফাঁক-ফোকড় ব্যবহার করে কলকাতার সিনেমাকে এদেশে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ থেকে অনন্য মামুনকে মুক্ত করা হলেও হিন্দী সিনেমা থেকে চুরি করার অভিযোগে শাস্তি প্রদান করা কর্তব্য।

গোঁড়ায় মনযোগ না দিয়ে ডালপালা ধরে টানাটানি আমাদের চিরন্তন অভ্যাস। পুলিশকে হেয় করে উপস্থাপন করার অভিযোগে পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেফতারের ঘটনায়ও আমরা তাই করছি। অনন্য মামুনের গ্রেফতার নয়, সিনেমায় পুলিশের উপস্থাপন বিষয়ে বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। সিনেমা মুক্তির পরে নয়, পূর্বেই সকল নীতিমালার প্রয়োগ নিশ্চিত করা উচিত। যথাযথ অনুমতি ব্যতিরেকে অন্য সিনেমার দৃশ্য চুরি করে ব্যবহার করার জন্য পরিচালক-চিত্রনাট্যকারের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত।

আমি গোঁড়াটা দেখিয়ে দিলাম , এবার আপনি কি বিষয়ে মনযোগ দিবেন সেটা আপনার ইচ্ছা!

ছবি: সারাবাংলা.নেট

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *