ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি: গোয়েন্দা সাহিত্যের সুলুকসন্ধান

Crime Kahinir Kalkranti ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি

সাহিত্যে অপরাধ কাহিনি বর্তমান সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ শাখা। সারা বিশ্বেই এ ধরনের সাহিত্যের আলাদা পাঠক আছে। সাধারণত কোন ক্রাইম সংঘটন এবং তার রহস্য উদঘাটন ও অপরাধীকে শাস্তি প্রদান এ ধরনের সাহিত্যের মূল বিষয়বস্তু। গোয়েন্দা কাহিনিও এ কারণে এই শাখার অন্তর্ভূক্ত। ঠিক কবে থেকে এ ধরনের সাহিত্যের শুরু, সারা দুনিয়ায় এ ধরনের সাহিত্যগুলো কারা রচনা করেছেন, তাদের সেই রচনাগুলোতে নতুনত্ব কিছু ছিল কিনা ইত্যাদি বিষয়ে সুলুক সন্ধান করেছেন সুকুমার সেন, বইয়ের নাম ‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’।

সাধারণত উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে গোয়েন্দা গল্প বা ক্রাইম কাহিনির যাত্রা শুরু বলে মনে করা হয়। পুলিশ বিভাগের কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে সাহিত্যে গোয়েন্দাগিরি শুরুর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হলেও সুকুমার সেন দাবি করেছেন— হাজার বছরের পুরানো সাহিত্যেও অপরাধ বিষয়ক কাহিনির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেমন, প্রাচীনতম লিখিত গল্প হিসেবে লেখক যাকে দাবি করেছেন সেটি ওল্ড টেস্টামেন্টের দানিয়েলের ঘটনা এবং সে হিসেবে প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো। একইভাবে এই উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্যেও ক্রাইম কাহিনির উপস্থিতি নির্ণয় করেছেন লেখক। মহাভারত, জাতক, পঞ্চতন্ত্র, ঋগ্বেদ, বিভিন্ন বৈদিক গ্রন্থ ইত্যাদি থেকে এ ধরনের গল্পগুলো বাছাই করেছেন।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই সকল গল্প কীভাবে ক্রাইম কাহিনির আওতাভূক্ত? মজার ব্যাপার হলো, এই প্রশ্নই লেখককে সারা বিশ্বের ক্রাইম কাহিনি নিয়ে গবেষণা ব্যপৃত হতে এবং পরবর্তীতে পুস্তক প্রকাশে উৎসাহিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কঙ্কাল’ গল্পটিকে সকলে ভৌতিক গল্প হিসেবে জানলেও লেখক একে ক্রাইম কাহিনি বলে দাবি করেছিলেন বন্ধুদের একটি আড্ডায়। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বেশিরভাগ সদস্য এর বিরোধিতা করায় তিনি গবেষণার প্রথম পর্ব শুরু করেন এবং কিছুদিন পরে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করে তার যুক্তিগুলো তুলে ধরেন যা তার বন্ধুদের বিরোধিতাকে থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল।

সুকুমার সেন প্রথমে ক্রাইম কাহিনিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এবং ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ক্রাইম কাহিনি, ডিটেকটিভ কাহিনি ইত্যাদির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেছেন। প্রাচীন সাহিত্য থেকে নেয়া ক্রাইম কাহিনির গল্পগুলো আকৃতিতে ছোট হলেও গোয়েন্দা গল্পের বৈশিষ্ট্যগুলো এর মধ্যে উপস্থিত থাকায় তিনি এ সকল কাহিনিকে ক্রাইম জনরার অন্তর্ভূক্ত করেছেন।

প্রাচীন সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে ক্রাইম কাহিনি বা গোয়েন্দা গল্প খুঁজে বের করার জন্য সুকুমার সেন উপযুক্ত লোক। তিনি ছিলেন একজন ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্য বিশারদ। বৈদিক ও ধ্রুপদী সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, বাংলা, আবেস্তা ও প্রাচীন পারসিক ভাষায় তার বিশেষ জ্ঞান ছিল। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থের নাম হলো ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ যা পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত। তার বাকি গ্রন্থগুলোও মূলত ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। ব্রজবুলি সাহিত্য, বাংলা ভাষাতত্ত্ব, বাংলা মেয়েলি ভাষা, বাংলা স্থাননাম, ইসলামী বাংলা সাহিত্য, রামায়ন-মহাভারত সংক্রান্ত তুলনামূলক পুরাণতাত্ত্বিক আলোচনা ইত্যাদি বিষয়ে তার বই রয়েছে। ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে যার এত গবেষণা, তিনি যদি প্রাচীন সাহিত্য থেকে গোয়েন্দা গল্প চিহ্নিত করেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’ বইতে মোট চারটি অধ্যায় রয়েছে— বুদ্ধিশরণ, বিদ্যাশরণ, ভাবশরণ এবং অনুশরণ। বুদ্ধিশরণ অধ্যায়ে ক্রাইম কাহিনির সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি উপস্থাপনের পাশাপাশি প্রাচীন সাহিত্যে লব্ধ গোয়েন্দা কাহিনীর পরিচয় তুলে ধরেছেন। খ্রিস্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে এই অধ্যায়ে ধারণ করেছেন লেখক।

দ্বিতীয় অধ্যায় বিদ্যাশরণে অষ্টাদশ শতাব্দী, উনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর তিন চতুর্থাংশ সময়ে রচিত গোয়েন্দা গল্প ও ক্রাইম কাহিনির বিষয়ে আলোচনা করেছেন সুকুমার সেন। এই সময়েই মূলত গোয়েন্দা গল্প রচনা শুরু হয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাহিত্যে বিশেষ শাখা হিসবে স্থান করে নেয়। সারা বিশ্বে পুলিশ ব্যবস্থার শুরুও এই সময়ে। পুলিশ ব্যবস্থা প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা গল্প বিস্তারের সম্পর্ক রয়েছে। পুলিশের কাজই হলো অপরাধীকে চিহ্নিত করে তাকে শাস্তি প্রদানের প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা। ডিটেকটিভ বা গোয়েন্দারা সেই কাজকে সহজ করে দেন। এই রহস্য সমাধানে যারা সাধরণত এককভাবে কাজ করেন তারা ডিটেকটিভ- যেমন; শার্লক হোমস কিংবা ব্যোমকেশ বক্সী। আবার দলবদ্ধভাবে কাজ করেন অনেকে, সাধারণত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা, যেমন সিআইডি, এফবিআই ইত্যাদি।

সুসাহিত্যিক ভলতেয়ার জাদিক নামের চরিত্রকে প্রথম আধুনিক গোয়েন্দা হিসেবে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেন। পরবর্তীতে পুলিশি ব্যবস্থার প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত ফরাসি লেখক ফ্রাঁসোয়া ভিদক্-কে প্রথম ক্রাইম কাহিনির রচয়িতা হিসেবে মনে করা হয়। তবে, নিয়মিত লিখে একে সকলের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এডগার অ্যালেন পো, তার প্রথম গল্প ‘মার্ডার ইন রু মর্গ’। গোয়েন্দা কাহিনির যে ধারা এডগার অ্যালেন পো শুরু করে দিয়েছিলেন সেখানে নতুন নতুন লেখক যুক্ত হলেন বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের গোয়েন্দাদের নিয়ে। কারো গোয়েন্দা খাটো, কারো লম্বা। কেউ মোটা, কেউ শুকনা। কারো অভ্যাস চুরুট টানা, কেউ হয়তো ধূমপান-মদ্যপান এড়িয়ে চলেন। কারো সহযোগী আছে, কেউ নিজেই তার অভিযানের কাহিনি বর্ণনা করছেন। পুরুষ লেখকদের পাশাপাশি আছে নারী লেখক। কেউ অল্প ক’টা গল্প লিখেই খ্যাতি পেয়েছেন, কেউ শতাধিক গল্প লিখেছেন। কেউ একটা গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করেছে, কেউ একাধিক। নিজ নামে লিখেছেন, আবার ছদ্মনামের লেখকরাও রয়েছেন। এই অধ্যায়ে মোটামুটি সকল গোয়েন্দা লেখক এবং তাদের সৃষ্ট চরিত্র, উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য, কিছু কাহিনির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ইত্যাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। বিখ্যাত কিছু লেখক, যেমন স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, অগাথা ক্রিস্টি, ব্যারনেস অর্কজি, এডগার ওয়ালেস, সমারসেট মম ইত্যাদি লেখকদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও তুলে ধরা হয়েছে।

ভাবশরন অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ও হেনরি – এই দুজন লেখক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। চতুর্থ অধ্যায় অনুসরণ-এ বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। সেখান থেকে জানা যায়, বাংলা সাহিত্যে ডিটেকটিভ গল্পের আমদানি হয়েছে ইংরেজি সাহিত্য থেকে। এমনকি, এ অঞ্চলের একজন চতুর বাঙালি যুবক দারোগা, বরকতউল্লাহ বা বকাউল্লা বা বাঁকাউল্লা, যিনি এ অঞ্চলের ঠগী ও ডাকাতদের শায়েস্তা করেছিলেন, তার দক্ষতার গল্পও প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজিতে যা পরে ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর’ নামে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়।

প্রথম যুগে সাধারণত দারোগা, পুলিশের কাহিনি গোয়েন্দা গল্প হিসেবে প্রচলিত ছিল। ইংরেজি সাহিত্য অবলম্বনে সে সময় অনেক গোয়েন্দা গল্প লেখা ও প্রকাশিত হয়। প্রথম মৌলিক গোয়েন্দা গল্প হিসেবে লেখক যেগুলোকে চিহ্নিত করেছেন তার মধ্যে একজন নারী লেখকও রয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা গল্প লেখকদের বর্ণনা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ে এসে থেমেছে। অর্থ্যাৎ লেখক ১৯৭০ পর্যন্ত সময়ে প্রকাশিত গোয়েন্দা গল্প বা ক্রাইম কাহিনি নিয়ে গবেষণা করেছেন। এর পরবর্তী সময়ের গোয়েন্দাদের স্থান হয়নি ‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’ বইয়ে।

এত এত গোয়েন্দা এবং তাদের লেখকদের পরিচয়, বিভিন্ন গোয়েন্দা কাহিনির নাম, প্রকাশের সন ইত্যাদি তথ্য সম্বলিত এই বইটি পাঠ করতে যেন পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক না ঘটে সেজন্য লেখক একটু পর পর বিভিন্ন ধরনের কাহিনি সংযোজন করেছেন। ফলে, বইটি পড়তে গিয়ে পাঠক যেমন হাজার বছরের পুরোনো গোয়েন্দা গল্প সম্পর্কে জানতে পারবে, তেমনি জানবে এডগার অ্যালেন পো-র গল্প, প্রথম বাংলা মৌলিক গোয়েন্দা গল্প ইত্যাদি প্রসঙ্গে। এ ছাড়া সেরা গোয়েন্দা গল্প ও ক্রাইম কাহিনির রচয়িতারা কীভাবে এ ধরনের রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন তার বর্ণনাও পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে।

‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’ প্রথম পুস্তকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। সুকুমার সেন প্রয়াত হন ১৯৯২ সালে। ফলে, পরবর্তী পরবর্তীতে আরও দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হলেও সেখানে নতুন গোয়েন্দা এবং তাদের স্রষ্টাদের স্থান হয়নি। কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স ১৯৬ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছিল, সর্বশেষ সংস্করণ ২০১২ সালে।

সুকুমার সেনের ‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’-ই সম্ভবত এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষায় সবচেয়ে সমৃদ্ধ রচনা যেখানে সারা বিশ্বের গোয়েন্দা চরিত্রদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। যে পাঠক সারা বিশ্বের ক্রাইম কাহিনি স্বাদ পেতে একটি তথ্যভান্ডারের সন্ধান চান, তার জন্য ‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’ আদর্শ স্থান।

দৈনিক দেশ রূপান্তর অনলাইন-এ প্রকাশিত

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *