লালবাজারের গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্ত তৃতীয়বারের মতো বড় পর্দায় হাজির হয়েছেন, এ কারণে এবারে ছবির নাম ‘আসছে আবার শবর’। যথারীতি শ্বাশত চট্টোপাধ্যায় আছেন শবরের রূপে, পরিচালনায় আরিন্দম শীল।
শবর পুলিশের গোয়েন্দা, প্রাইভেট ডিটেকটিভ নন। শবরকে যে কেসগুলোর সমাধান করতে হয় সেগুলো আবার বড়দের, ফলে প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়াদি ঘুরে ফিরে আসে, তবে সেটা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তাহলে কিন্তু বিরক্তির উদ্রেক হবেই। তৃতীয়বার হাজির হয়ে গোয়েন্দা শবর যতটা তৃপ্ত করেছে, ‘আসছে আবার শবর’ দিয়ে অরিন্দম শীল ততটাই বিরক্ত করেছেন।
একুশ বছরের রিঙ্কু ধনী বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে, এবং বখাটে। তার আপন মা তার ছোটবেলায়ই বন্ধুর হাত ধরে চলে গিয়েছিল, সৎ মা তাকে পছন্দ করে না। রিঙ্কু ভালোবাসে তার প্রায় দ্বিগুন বয়সের সুদর্শন যুবক বিজয় সেনকে, যার বউ বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই চলে গিয়েছে এবং যাকে সবাই লম্পট বলেই জানে। সেই রিঙ্কু একদিন ধর্ষণের শিকার ও খুন হয়ে গেল, সন্দেহ সেই বিজয়ের দিকে। একই প্যাটার্নে খুন হয়েছে আরও দুজন কলগার্ল, ফলে মাঠে নামলেন গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্ত।
মূল গল্পের লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, গল্পের নাম ‘প্রজাপতির মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম’। মূল গল্পটি খুবই চমৎকার, গোয়েন্দা শবরের বাকী গল্পগুলোর বৈশিষ্ট্য এখানেও উপস্থিত ছিল। পরিচালক অরিন্দম শীল বোধহয় তার উপস্থাপনে ভিন্নতা আনতে চেয়েছিলেন। তাই গল্পের পুরোটা অনুসরণ না করে তিনি নিজের মতো চলেছেন এবং সেটা করতে গিয়ে কিছু ভজঘট করে ফেলেছেন।
যেমন শবরের উপস্থিতির ঘটনা। শবরের আকর্ষণে সিনেমার দর্শক পর্দার সামনে উপস্থিত, কিন্তু সেই শবরের দেখা পাওয়া গেল বেশ পরে। ততক্ষণে সিনেমা ঝুলে যাচ্ছিল প্রায়। শবর হাজির হওয়ার আগ পর্যন্ত যা চলেছে তাতে গোয়েন্দা থ্রিলার গল্পের পরিবর্তে ইরোটিক সিনেমা ডাউনলোড করে ফেলেছি কিনা ভাবতে হয়েছিল। আর হ্যা, বিজয় সেনকে লম্পট ও দোষী প্রমাণের জন্য অরিন্দম শীলও কম চেষ্টা করেন নি, এমনকি দর্শককে ভিডিও পর্যন্ত দেখিয়েছেন। ফলে শেষ পর্যন্ত যখন উল্টো তথ্য-প্রমাণ হাজির হতে শুরু করলো তখন দর্শক হিসেবে তালগোল পাকিয়ে গেল, ‘ইয়ে, ভিডিও-তে যে দেখলাম…!’ তারপর ধরুন, রিঙ্কুর ঠাকুমার বিষয়টা। তিনি কেন যে গোপন করে যেতে চাচ্ছিলেন সেটা কি কোথাও স্পষ্ট হয়েছে? আর শেষ পর্যন্ত যাকে সত্যিকারের খুনী হিসেবে ধরা হলো, সে তো উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে না চাপিয়ে একেবারে মোখলেসের ঘাড়ে ফেলার মতো অবস্থা। শবর দাশগুপ্ত এদেশের পুলিশ হলে শতভাগ নিঃসন্দেহ হওয়া যেতো যে, পুলিশের মারের চোটে সে ব্যাটা সব স্বীকার করে বসে আছে। ওদেশের পুলিশ যে সেরকম করে না সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না, ফলে শবর দাশগুপ্ত সঠিক খুনীকে ধরতে পেরেছেন বলে বিশ্বাস করে নিতে হলো।
যাহোক, শ্বাশত অনবদ্য অভিনয় করেছেন। আর বিজয় সেনের স্ত্রীর চরিত্রে অরুনিমা ঘোষ। বাকীরা ওভার অ্যাক্টিং করে করে বিরক্ত করেছেন। রিঙ্কু চরিত্রে দিতি সাহা বেশ ভালো ছিলেন, কিন্তু একুশ বছরের মেয়ের চরিত্রে তিনি কেন ষোল বছরের মেয়ের অভিনয় করলেন সেটা স্পষ্ট হয়নি। অরিন্দম শীল হয়তো ভালো বলতে পারবেন।
লালবাজারের গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্তের প্রতি আমার আলাদা ভালোবাসা রয়েছে এবং সেটা বড় পর্দায় উপস্থিত হওয়ারও বহু বছর আগে থেকে, যখন তিনি বইয়ের পাতায় ছিলেন এবং যখন তাকে খুব বেশী লোকে চিনত না। ফলে তৃতীয়বারের মতো শবর দাশগুপ্ত যখন বড় পর্দায় হাজির হচ্ছেন জেনেছি, তখন পরিচালক অরিন্দম শীলের প্রতি শ্রদ্ধাও জেগেছে। এবার শবর কিংবা ঈগলের চোখ-এ তিনি মোটেও হতাশ করেননি অথচ ‘আসছে আবার শবর’-এ তিনি গল্প বলার চেয়ে দেখানোর ব্যাপারেই বেশী আগ্রহী ছিলেন। অকারণ খোলামেলা দৃশ্য দেখতে গিয়ে দর্শক যে বিরক্ত হবেন সেটা সম্ভবত তিনি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন, তাই ছবির পরিচালকের নামের স্থানে ‘অরিন্দম শীল এন্ড টিম’ লিখে সবাইকে পাপের ভাগীদার বানিয়েছেন।
গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্ত বারবার আসুক চলচ্চিত্রে, কোন আপত্তি নেই, কিন্তু এমনভাবে আসুক যাকে আরও বেশি ভালোবাসা যাবে, যে কিনা বিরক্তির কারণ হবে না।
কলকাতার বাংলা সিনেমা গুলোতে ইদানিং বেশ ইরোটিসিজম চলছে, আর গোয়েন্দা কাহিনী দেখার আলাদা গোষ্ঠী তো রয়েছেই, পরিচালক দুই গোষ্ঠীকেই খুশি করতে চেয়েছেন। যার যেটা দরকার সেটা সে নিয়ে নেবে। ট্যালেন্ট আছে বলতে হবে, মুভিটা কবে দেখতে পাবো সেই ওয়েট করছি।
ধন্যবাদ। ছবিটি পাবেন বিভিন্ন টরেন্ট এবং স্ট্রিমিং সাইটে। আগ্রহ থাকলে দেখে নিতে পারেন।