গুলশান তেজগাঁও লিংক রোডে একটা মসজিদ আছে, নিকেতন চার নাম্বার গেট থেকে বের হলে ডিএইচএল অফিসের বিপরীতে, নাম সম্ভবত বায়তুল ফালাহ। সেই মসজিদের ঘটনা, গেল রমজানের আগে। মাগরিব বা ইশার নামাজ চলাকালীন ইমাম সাহেব সূরা ফাতেহা পড়া শেষ করেছেন আর একজন মুসল্লি উচ্চস্বরে আমিন বললেন।
নামাজ শেষে সেই মুসল্লিকে ধরা হল। নামাজের মধ্যে উচ্চস্বরে আমিন কেন বললেন এই বিষয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে কেউ দুম করে ঘুষি দিয়ে মুসল্লির নাক ফাটিয়ে দিলেন, সাথে আরও কিছু কিল ঘুষিও যোগ হল। নিয়মিত মুসল্লিদের দয়ার শরীর, জানে না মেরে সেই মুসল্লিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সম্ভবত বাকি জীবন ধরে যেন সেই শিক্ষা অন্যদেরকে জানাতে পারে এবং জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাওয়ায় আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে – এই সুযোগ দেয়ার জন্য।
আমি এই ঘটনা নিজে দেখিনি, ওই মসজিদের নিয়মিত এক মুসল্লির কাছ থেকে শুনেছি। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, পরবর্তীতে নাকি ওই মসজিদে এই ‘আহলে হাদীস’ তরিকার নিয়ম অনুসরণ না করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে নোটিশ টাঙ্গানো হয়েছিল।
এই ঘটনা যখন শুনছি তখনই আমার মনে পড়ে গেল মোহাম্মদপুরে এক মসজিদে জুমা পড়ার সুযোগ হয়েছিল। বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত আলেম এবং টিভি ব্যক্তিত্ব সেই মসজিদে কোন কোন জুমায় খুতবা দেন, সেদিনও দিয়েছিলেন। মসজিদ বেশ প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত, কিন্তু জুমা পড়ার জন্য লোকজন রীতিমত গাড়ি হাকিয়ে, সিএনজিতে করে হাজির হয়। ভেবেছিলাম খুতবা শোনার জন্য আসেন বোধহয়। নামাজে দাঁড়িয়ে ওই মসজিদের বৈশিষ্ট্য বুঝতে পেরেছিলাম। পায়ের সাথে পা লাগিয়ে দাঁড়ানো আর সূরা ফাতেহার পর সমস্বরে ‘আমিন’ শুনে বুঝলাম – আহলে হাদীসদের (নাকি সালাফি?) মসজিদে নামাজ পড়তে এসেছি। নিজেদের সুবিধার্থে তারা আলাদা মসজিদও বানিয়ে নিয়েছেন।
এখন যে মসজিদে জুমা পড়ি সেই মসজিদের ইমাম চার সপ্তাহ আগে থেকে নতুন মিশন শুরু করেছেন। মিশনের নাম সম্ভবত ‘আহলে হাদীস নির্মূলকরন’। উনি পুরো সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি নেন আর জুমার খুতবায় ‘কেন আহলে হাদীসরা খারাপ’ সেই বিষয়ে উত্তেজক বক্তব্য দেন। আহলে হাদীসদের ইহুদী নাসারাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নকারী হিসেবে দায়ীও করেছেন। তার সেই বক্তব্যের রেশ চলে নামাজের পরও।
জামায়াতের শেষে দেখলাম সুন্নাত না পড়েই তিন তরুণ এই নিয়ে আলোচনা করছেন। তাদের একজন বেশ উদ্যমী, তিনি জোরের সাথে আহলে হাদীসদের ভুল প্রমাণ করে ব্যঙ্গ করে যাচ্ছেন। তরুণরা চলে যাওয়ার পর দেখলাম পয়ঁত্রিশোর্ধ কয়েক যুবক এই নিয়ে আলোচনা করছেন। এখানেও উদ্যমী একজন আছেন, তিনি উদাহরণ দিয়ে মসজিদে বসার সঠিক তরিকা কি তা দেখিয়ে দিচ্ছেন। পরিস্থিতি এভাবে আগাতে থাকলে এই মসজিদেও একদিন কারও নাক-মাথা ভাঙবে নিশ্চিত।
ফেরার সময় দেখি সেই তিন তরুণ তুর্কি তখনো এই নিয়ে আলোচনা করছেন। আমি দোকান থেকে কিছু সদাই কিনবো বলে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিলাম। মুরুব্বী এক লোক তাদের থামালেন।
এই যে তোমরা, অনেক তো আলোচনা করতেছো, আমাকে কয়েকটা ব্যাপার বুঝাও তো। এই যে আহলে হাদীস, এরা কি অমুসলমান?
জ্বী না।
খারাপ মুসলমান?
খারাপ না, তবে ভুল আছে অনেক, একজন বলল। ভালো না খারাপ সেইটা আল্লাহ ভালো জানে, আরেকজন বলল।
সেইটাই। কে ভালো কে মন্দ, কে ভুল আর কে সঠিক, আল্লাহ ছাড়া আর কে জানে? আমরা যদি তাদের ভুল বা খারাপ মুসলমান প্রমাণ করি তাহলে কি আমরা ভালো আর সঠিক হবো? আল্লাহ বলছেন এই কথা?
এইবার তরুণরা চুপ।
মুসলমানদের মধ্যে যদি আমরা এইভাবে মারামারি করি, মসজিদ ভাগাভাগি করি তাহলে জিতবে কে? মাজহাবিরা নাকি আহলে হাদীসরা? নাকি ইসলামের শত্রুরা?…
মুরুব্বি তার বক্তৃতা চালিয়ে যেতে লাগলেন, আমি বাসায় চলে এলাম।