গত শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশরা একটি বিশাল রেলওয়ে নির্মানের চিন্তা করেছিল। রেলওয়েটি নির্মান করা হবে থাইল্যান্ড থেকে বার্মা পর্যন্ত – পাহাড়-জঙ্গল-নদী ডিঙ্গিয়ে। ফলে চীন থেকে ভারত পর্যন্ত রেলওয়ের মাধ্যমেই যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে এবং এই থাই-বার্মা রেলওয়ে বিশ্বের সেরা কিছু রেলওয়ে ভ্রমন যেমন ট্রান্স সাইবেরিয়া রেলওয়ে, ওরিয়েন্স এক্সপ্রেস কিংবা কানাডিয়ান প্যাসিফিকের পাশাপাশি আরেকটি নাম হিসেবে যুক্ত হবে। সব হিসেব নিকেশ শেষে ব্রিটিশরা পিছিয়ে এলেও চল্লিশের দশকে জাপানীরা পিছিয়ে এলো না, তারা ঠিক নির্মান করল থাই বার্মা রেলওয়ে।
দ্য রেলওয়ে ম্যান
এই রেলওয়ে নির্মানকে কেন্দ্র করে হাতে গোনা যে ক’টি সিনেমা নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই সবচে জনপ্রিয়। কিন্তু এই চলচ্চিত্রটি সত্যকে তেমনভাবে উপস্থাপন করে না যেমনটি করে সাম্প্রতিককালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র দ্য রেলওয়ে ম্যান।
ব্রিটিশরা কেন মাপ-জোক করার পরেও রেলওয়েটি নির্মান করেন নি তার উত্তর পাওয়া যায় দ্য রেলওয়ে ম্যান চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র এরিক লোম্যাক্সের সংলাপে – To build such a railway, it would be an act not of engineering, but of extreme barbarity and cruelty. এই নিষ্ঠুরতার প্রকৃতি কি সেটা ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই-তে ফুটে উঠলেও পূর্ণ রূপ পেয়েছে রেলওয়ে ম্যান চলচ্চিত্রে।
রেলপথ নির্মানে নির্মমতা
বিশ্বের বড় বড় রেলপথগুলো নির্মানের মত কঠিন ও পীড়াদায়ক জন্য নির্ভর করতে হয়েছে দরিদ্র, অভিবাসী শ্রমিকদের উপর। আমেরিকানরা চায়নিজ শ্রমিকদের সহায়তায় রেলরাস্তা তৈরী করে। ব্রিটিশরা দুর্ভিক্ষের কবল থেকে পালিয়ে আসা আইরিশদের কাজে লাগিয়েছিল। অন্যদিকে, জাপানীরা থাই বার্মা রেলওয়ে নির্মানের জন্য বাধ্য করেছিল এশিয়ান শ্রমিক এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বন্দী শ্রমিকদের। উইকিপিডিয়া বলে মোট ১ লক্ষ ৮০ হাজার এশিয়ান শ্রমিক এবং ৬০ হাজার যুদ্ধবন্দীকে বাধ্য করা হয়েছিল মাত্র এক বছরের মধ্যে এই রেলওয়ে নির্মানের জন্য। এদের মধ্যে ৯০ হাজার এশিয়ান শ্রমিক এবং ১২ হাজারের বেশী যুদ্ধবন্দী নির্মানকাজে রত অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে।
নির্মমতা, প্রেম নাকি বন্ধুত্ব
দ্য রেলওয়ে ম্যান চলচ্চিত্রে শুধু এই নির্মমতা তুলে ধরা হয় নি, বরং প্রেম ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের গল্প বলা হয়েছে। মধ্যবয়সে পরিচয় থেকে প্রেম এবং পরিণয়ের মাধ্যমে জুটি বাঁধেন এরিক লোম্যাক্স এবং প্যাটি। কিন্তু বিয়ের পরে স্বামীর মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক আচরণের কারণ খুঁজতে গিয়ে প্যাটি জানতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধচলাকালীন জাপানী সেনাবাহিনী কর্তৃক এরিকের অমানবিকভাবে অত্যাচারিত হবার কথা। তারচেয়েও বড় কথা, সেই সময়ে জাপানী সেনাবাহিনীর পক্ষের অনুবাদক এবং অত্যাচারের সহায়ক তাকাশি নাগাসি’র সন্ধান পাওয়া যায়। প্রায় দুই দশক পরে নাগাসি আর লোম্যাক্সকে কেন্দ্র করে গল্প মোড় নেয় নতুন দিকে।
যুদ্ধকালীন অত্যাচার আর নিষ্ঠুরতা ছবির প্রধান বিষয় না হলেও লোম্যাক্সের চরিত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রধান যে বিষয়টি দর্শককে চমকিত করবে তা হল বন্ধুত্ব – পুরো ছবি জুড়েই লোম্যাক্সের মাধ্যমে বন্ধুত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। এই ছবির সবচে চমকপ্রদ অংশ হল – নাগাসির সাথে লোম্যাক্সের সম্পর্কের রসায়ন! এই সম্পর্ক কে কিভাবে গ্রহণ করবে তা পুরোটাই নির্ভর করবে দর্শকের মন-মানসিকতার উপর। তবে এই অংশটিই যে এই ছবির সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে তা নিঃসন্দেহ।
দ্য রেলওয়ে ম্যান চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে বাস্তব ঘটনার উপর নির্ভর করে। এরিক লোম্যাক্স একই নামে আত্মজীবনি লিখেছিলেন, জোনাথন টেপলিজকি সেই বইয়েরই চলচ্চিত্রায়ন করেছেন। বয়স্ক এরিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন কলিন ফার্থ, যুবক এরিক চরিত্রে জেরেমি আরভিন, স্ত্রী প্যাটি চরিত্রে নিকোল কিডম্যান এবং নাগাসি চরিত্রে তানরো ইশিদা।
দেখতে হবে। ওয়াচলিস্টে রাখলাম।
রিভিউ দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে। সময় পেলে অবশ্যই দেখবো।
রিভিউ লেখার জন্য ধন্যবাদ।