আশীর্বাদপুষ্ট যানজট এবং যাত্রা
‘ভাই, বাস তো দশমিনিট পরে ছেড়ে দিবে। আপনি সায়েদাবাদ চলে যান, ফকিরাপুল আসার দরকার নেই’ –মাঝের (মাজহার) ভাই যখন মোবাইলে আমাকে এই পরামর্শ দিচ্ছে আমি তখন রিকশায়, আধাঘন্টা ধরে শাহবাগের ট্র্যাফিক জ্যামে আটক হয়ে অক্ষম রাগে ফুঁসছি। যে রিকশায় বসে আছি সেটা ঢাকার ইঞ্জিনচালিত স্পোর্টস রিকশা নয় এবং আমার পাইলট মাইকেল শুমাখারও নন। সুতরাং দশ মিনিটে শাহবাগ থেকে ফকিরাপুলে পৌছানো আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। অথচ সায়েদাবাদ যেতে হলে শর্টকাটে গেলে ফকিরাপুল হয়েই যেতে হবে। বাস যদি সঠিক সময়ে ফকিরাপুল ছেড়ে যায়, তবে আমি সায়েদাবাদ পৌছানোর আগে বাস সেখান থেকেও ছেড়ে যাবে – যদি না পারভেজ ভাই কাউন্টারে বলে কিছু সময় অপেক্ষা করিয়ে রাখে। অতএব, রিকশায় বসে থেকে মোবাইলে অ্যাংরি বার্ডস খেলে ‘অ্যাঙ্গার’ (রাগ) দমন করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকল না – যা হোক হবে!
নির্দিষ্ট সময়ের দশ মিনিট পরে ফকিরাপুল পৌছে দেখি সবাই অপেক্ষা করছে – যানজটের কারণে বাস এখনো কাউন্টারে পৌছায় নি। বাঁচা গেল! ট্র্যাফিক জ্যাম শুধুমাত্র অভিশাপ নয়, কখনো কখনো আশীর্বাদও হতে পারে – আমি সাক্ষী! গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে অপেক্ষারত আলম ভাই, তোফা ভাই, মান্না ভাই, বাবু ভাই, দাদা, মাঝের ভাই, কাজী ভাই, এনাম ভাই, আলফাজ ভাই, গোলাম মোস্তফা ভাই সহ সতেরো জনের দলের এক কোনায় দাড়িয়ে যে ছেলেটা তাকে দেখেই অবাক – নাহিদ! আবার দেখা হয়ে গেল। শেষবার দেখা হয়েছিল বছর তিনেক আগে অফিসের আয়োজনেই পিকনিকে।
বেশী সময় অপেক্ষা করতে হল না। বাস চলে এলো। উঠে পড়লাম একে একে। আমাদেরকে এবং আরও কিছু যাত্রী নিয়ে বাস ছাড়ল। গন্তব্য – নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপ।
বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়!
নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপকে সেন্টমার্টিন্স নামে চিনে সবাই, নারিকেল জিঞ্জিরা হল এর আদুরে নাম। তবে একসময় এই দ্বীপকে স্থানীয় লোকেরা আরব বণিকদের দেয়া জিঞ্জিরা নামে ডাকতো। সেন্টমার্টিন্সের বৈশিষ্ট্য হল – এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। দ্বীপের তিন দিকে প্রায় ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ভিত শিলা। জোয়ারের সময় এ শিলাগুলো তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় আবার জেগে ওঠে। পশ্চিম-উত্তর দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর।
এখন প্রায় আট হাজার লোক বসবাস করলেও এই দ্বীপে মানুষের বসতি সোয়া একশন বছরের বেশী না। শোনা যায়, মোট তেরোটি পরিবার এই দ্বীপের মালিক ছিল। পরবর্তীতে মালিকানা ভাগ হয়েছে সময়ের সাথে সাথে, মালিকানা পরিবর্তন চলছে এখনো। দ্বীপে কেয়াগাছ, ঝাউগাছ আগে থেকেই ছিল, শত বছর আগে জেলেরা ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে নারিকেল গাছ লাগিয়েছিল – সেই গাছে সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দ্বীপের নামই হয়ে গেল নারিকেল জিঞ্জিরা। অবশ্য এর পোষাকি নামের ইতিহাসও দীর্ঘ। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরীপ দল এই দ্বীপটিকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করেছিল। জরীপের পর খ্রিষ্টান সাধু মার্টিনের নামানুসারে সেন্ট মার্টিন নাম প্রদান করে। এরপর দ্বীপটি সেন্ট মার্টিন নামেই পরিচিত লাভ করে।
সেন্ট মার্টিন্সে যাওয়া বর্তমানে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। যে কোন জায়গা থেকে বাসে করে টেকনাফে গিয়ে চারটে শীপের যে কোনটিতে চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিন্সে পৌছে যাওয়া যায়। অ্যাডভেঞ্চারের জন্য অনেকে অবশ্য মাছ ধরা ট্রলারেও সমুদ্র পাড়ি দেয় – তবে সেটা খুবই অনিরাপদ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিপজ্জনক। সমুদ্র পাড়ি দেয়ার জন্য আমাদের সবসময়ের পছন্দ কেয়ারী সিন্দাবাদ শিপ, এবারও শিপের একদম প্রথম সারিতে বসে সমুদ্র দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপে।
কুকুর দৌড়
জিঞ্জিরায় থাকবো পুরো দুটো দিন। সুতরাং বিচে যাওয়ার তাড়া ছিল না। দুপুরে খেয়ে-বিশ্রাম নিয়ে তারপর সৈকতের দিকে চলল সবাই। আমার ও মান্না ভাইয়ের কাঁধে একটা করে কাপড়ের ছোট্ট ব্যাগ, দু’তিনজনের হাতে ক্যামেরা, আরও অনেকের হাতে মোবাইল এবং প্রায় সবার পায়ে পায়ে ঘুরছে একটি ফুটবল। এই গ্রুপটা পিকনিকে গেলেই একটা ফুটবল সাথে যায়, পিকনিক স্পটে একটা ফুটবল ম্যাচ হয় – বিবাহিত এবং অবিবাহিত গ্রুপের মাঝে, এবং প্রতিবারই স্বাভাবিক নিয়মে অবিবাহিত গ্রুপ ম্যাচ জেতে।
প্রায় সবার পায়েই স্যান্ডেল। ম্যাচ শুরুর আগেই বল নিয়ে খেলা শুরু হয়ে গেল। খেলার সুবিধার্থে পায়ের স্যান্ডেল এক জায়গায় জমা করে খেলতে গেল সবাই। কিন্তু বিপত্তি শুরু হল একটু পরেই। সমুদ্রের ঢেউ এসে স্যান্ডেল ভাসিয়ে নিতে শুরু করল। বিচ থেকে একটু দূরে শুকনো বালুর উপর স্তুপ করে রাখা হল স্যান্ডেল। খেলোয়ারদের মোবাইল ফোন এবং কারও কারও মানিব্যাগের জায়গা হল আমার কাঁধের ব্যাগে। মান্নান ভাই তার কাঁধের ব্যাগ স্যান্ডেলের স্তুপের উপর রেখে ‘একটু দেইখেন’ বলে খেলতে নেমে গেলেন সমুদ্রে।
স্যান্ডেলের দারোয়ানশিপ বেশী সময় ভালো লাগল না। আমি ক্যামেরা হাতে বিচে ঘুরতে লাগলাম একাকী। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি সমুদ্র থেকে উঠে মাঝের ভাই প্রাণপণ দৌড়ুচ্ছে – উনার সামনে একটি নেড়ি কুকুর! কি ব্যাপার? ভালো করে তাকাতেই দেখলাম – কুকুরের মুখে মান্না ভাইয়ের ব্যাগ! সর্বোনাশ!
কুকুর আর মানুষের দৌড়ে কুকুরই এগিয়ে থাকল, তবে জিতল মাঝের ভাই। কুকুরটা মুখ থেকে ব্যাগ ফেলে দিতেই মাঝের ভাই দৌড় থামিয়ে দিলেন। দৌড় প্রতিযোগিতা থেকে মাঝের ভাই এভাবে বিদায় নেবেন – কুকুরটির ধারনায় ছিল না, সেও দৌড় থামিয়ে একটু দূর থেকে মাঝের ভাইকে দেখতে লাগল। দৌড় জেতা মাঝের ভাইয়ের উদ্দেশ্য ছিল না, ব্যাগ নিয়ে তিনি ফিরলেন দলের মাঝে। পরে জানা গেল – ওই ব্যাগের ভেতরে ছিল নগদ বাষট্টি হাজার টাকা – পুরো ট্যুরের খরচ।
ট্যুরের বাকী সময়ে মান্না ভাইয়ের পিঠ থেকে ওই ব্যাগ আর নামতে দেখি নি।
গর্জন, তবে সমুদ্রের নয়
আমরা যে কটেজে সেটা সেন্ট মার্টিন্স বাজারের একদম সাথেই। পুরো কটেজে আমরাই বাসিন্দা। গত রাতের বাস ভ্রমণে সবার ঘুম ভালো হয় নি, তার উপর সারাদিন সি-বিচে দৌড়াদৌড়ি, দাপাদাপি এবং পেট ভর্তি করে সুস্বাদু ডিনার – ফলে ডিনার শেষে রুমে ফিরেই কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। কথাবার্তা বন্ধ হতেই গর্জন শোনা যেতে লাগল। সেন্ট মার্টিন্সে এসেছি, সুতরাং সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাবো – এমনটাই স্বাভাবিক, তাই শুরুতে তেমন একটা মনযোগ দিলাম না। কিন্তু একটু পরেই হঠাৎ খটকা লাগল! আমাদের কটেজটা তো সৈকতের কাছে নয়, বরং বাজারের মধ্যে, সমুদ্রের গর্জন এত দূরে আসার কথা না। তাছাড়া, আওয়াজটা ঠিক সমুদ্রের গর্জনের মত নয়, কেমন একটা ছন্দ আর বিরতি মিলিয়ে শোনা যাচ্ছে।
সমুদ্রের গর্জন নয় – নাসিকা গর্জন! সব রুমেই দু’তিনজন করে বিকট শব্দে তাদের নাক ডাকছে! সম্মিলিত সেই নাক-ডাক রীতিমত গর্জনে রূপ নিয়েছে। রীতিমত প্রতিযোগিতা যেন! ঘুমের মাঝে কে কার চেয়ে বেশী শব্দে নাক ডাকতে পারে! কাজী ভাইও চিন্তায়ও বোধহয় একই কথা খেলে গিয়েছিল। সে তার মোবাইল ফোনে রেকর্ডার অন করে একে একে সকলের নাক ডাকার শব্দ রেকর্ড করতে শুরু করল।
কারা কারা নাক ডেকেছিল তা আর না বলি – তবে পরদিন রেকর্ড করা নাসিকা গর্জন শুনতে শুনতে আমরা সবাই মিলে যেভাবে হেসেছিলাম – তাকে এক কথায় হাস্য-গর্জন বলা যেতে পারে।
উড়ে যায় মাথার হ্যাট
নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপে আমরা ছিলাম সব মিলিয়ে দুই দিন। কেয়ারী সিন্দাবাদ শিপে করেই টেকনাফ ফিরবো। বাতাসের বেগ একটু বেশী, বিশাল সমুদ্রের বুকে আমাদের জাহাজটি যেন কাগজের নৌকা – দুলছে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে সমুদ্রের ডেকে দাড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমি ভেতরে চেয়ারে বসে গত দুই দিনে তোলা ছবিগুলো দেখছিলাম। বাকীদের কেউ জাহাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ কেউ তিন চারটি চেয়ারের উপর শরীর বিছিয়ে চোখ বুজেছে।
শিহাব ভাই আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন দ্বিতীয় দিন। তিনি এসেছেন একাই, কিন্তু ফিরছেন আমাদের সাথে। জাহাজের ডেকে গিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তুলছিলেন তিনি। চোখের উপর রোদ পড়ছে বলে মান্নান ভাইয়ের মাথা থেকে বড় হ্যাটটা ধার চেয়ে নিলেন। মাথায় হ্যাট চাপিয়ে ছবি তোলার জন্য যেই না বুকে হাত বেঁধে দাড়ালেন তিনি, অমনি দমকা এক বাতাসে মাথার হ্যাট শূন্যে উড়ে গেল। হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করেছিলেন, পারলেন না। ক্যামেরায় ছিলেন পারভেজ ভাই, তিনিও ধরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তারও হাতের নাগালের বাইরে দিয়ে হ্যাট চলে গেল সীমানার বাইরে – একেবারে সমুদ্রে!
ফিরতি যাত্রায় এভাবে সমুদ্রে হ্যাট বিসর্জন দেয়ার ঘটনায় কেউ বিচলিত হল না বরং সবাই মিলে হাসতে লাগল। সেই হাসির মাঝে আমি পষ্ট দেখতে পেলাম – গত দুই বছরে প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত টার্গেট অ্যাচিভ করিয়ে দেয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে ক্লান্ত ছিল যে মানুষগুলো, নারিকেল জিঞ্জিরার সৈকত আর বাতাসে তা উড়ে হারিয়ে গেছে সমুদ্রে, হ্যাটের মতই। ফিরে গিয়ে নতুন বছরে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করবে এই পরিবারের সবাই।
ক্লান্ত শরীরে এক অদ্ভুত তৃপ্তিতে আমার চোখ জুড়িয়ে আসছিল। তিনটে চেয়ারে লম্বা হয়ে আমিও চোখ বুজলাম – আবার আসবো নারিকেল জিঞ্জিরা, খুব শীঘ্রই।
পড়ে ভালো লাগলো। আচ্ছা, আপনার ওয়েবসাইটের ইংরেজি ফন্টটা মনে হয় Ubuntu, তাই না?
জ্বি পান্থ। আপনি ঠিক ধরেছেন। 🙂
উবুন্টু আমার খুব প্রিয় একটা ফন্ট। দারুণ সুন্দর। আমি আমার পিসির (উইন্ডোজ এইট), ডিফল্ট ফন্ট হিসাবে একবার উবুন্টু সেট করছিলাম। তবে সেইটা একেবারে জঘন্য মনে হইছিল। উবুন্টু মনে হয় একমাত্র উবুন্টু ওএস-এই সুন্দর মানায়।