হেলিকপ্টার!

সেই বাচ্চাকালে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনে দেখার জন্য আগ্রহী হযনি এমন মানুষের সংখ্যা বোধহয় খুব নগন্য। গুড় গুড় শব্দ করে যখন হেলিকপ্টার মাথার উপর দিয়ে ছুটে যেত তখন তাকিয়ে থাকতাম অনেক আগ্রহ নিয়ে, না জানি কেমনে উড়ে… যদি পড়ে যায়?

আমি জন্মেছি চট্টগ্রামে, বড় হয়েছি সেখানেই। কলোনীতে থাকতাম। একতলা বাসা। যখন হেলিকপ্টার আসার আওয়াজ পেতাম, দুড়দাড় করে ছুটে বেরোতাম, বাসার জানালা দিয়ে দেখা যেত না বলে। মাথার উপর দিয়ে হেলিকপ্টারটা চলে যেত, তারপর বাসার ছাদের উপর দিয়ে আর তারপর রুবেলদের বিল্ডিং এর ছাদের উপর দিয়ে… কোথায় যে যেত তা জানা ছিল না। কিন্তু দৈনিক একবার দুবার যখনই যেত কখনোই দেখার ইচ্ছেটা মরে যেত না। মনে আছে এরকম অনেকদিন হয়েছে, খেলার মাঠে ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে দাড়িয়ে আছি, হঠাৎ হেলিকপ্টার এল, ব্যাটিং বাদ দিয়ে হা করে আকাশে তাকিয়ে আছি দেখার জন্য। রোদের দিকে কি তাকিয়ে থাকা যায়, হেলিকপ্টার যেতে যেতে তিন চারটে হাচি দেয়া শেষ, কিন্তু দেখা বাদ যায়নি।

হেলিকপ্টার নিয়ে এই আগ্রহটা সবারই থাকে, বিশেষ করে ছোটবেলায়। আমারও ছিল… … এখনও আছে। হেলিকপ্টার গেলে এখনোও সব বাদ দিয়ে তাকিয়ে থাকি, মনে থাকে না কোথায় আছি।

হেলিকপ্টার যে অনেক বিশাল জিনিস সে ব্যাপারে আমার কোন ধারনা ছিল না, যেহেতু সামনা সামনি কখনোও দেখিনি। দেখার সুযোগটা হয়ে গেল একদিন। ‘৯১র বন্যার পর ত্রান নিয়ে হেলিকপ্টারের আনাগোনা বেড়ে গেল অনেক। সেই সময় একদিন দেখলাম, হেলিকপ্টারটা প্রায় আমাদের ছাদ ছুয়ে চলে গেল, যদিও আমার ভাইয়া বলেছিল ছাদ ছুয়ে নয় বরং প্রায় ছ’ সাত তলা উচু দিয়ে উড়ে গিয়েছিল, আমার বিশ্বাস হয়নি।

তারপর একদিন বিশাল এক ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের কলোনীর পাশে এক বিশাল মাঠ আছে, এরশাদের আমলে সেখানে একবার স্কাউট জাম্বুরী হয়েছিল, তাই তার নাম জাম্বুরী মাঠ। সেই মাঠে এক বিশাল হেলিকপ্টার নামল। আর্মির পোশাক পড়া কয়েকজন লোকও বেরোল সেখান থেকে। আমরা দৌড়ে দৌড়ে জাম্বুরী মাঠে গেলাম হেলিকপ্টার দেখার জন্য। বেশীক্ষন ছিল না অবশ্য, আধাঘন্টা বাদেই তারা উড়ে যায়। কোন প্রয়োজনে জরুরী অবতরনের ঘটনা ছিল সেটা।

থ্রিলার বইয়ের সাথে পরিচিত হয়েছি তখন। কাজী আনোয়ার হোসেনের কুয়াশা সিরিজের পাগল ভক্ত। এক বইয়ে একটি চরিত্র পাওয়া গেল যে নাকি দুটো ম্যাচ বক্সের উপর একটা হেলিকপ্টার নামাতে পারে। কি অসম্ভব ঘটনা! তার পর থেকে আমি গবেষনায় মেতে গেলাম কোথায় কোথায় হেলিকপ্টার নামানো সম্ভব। জানতে পারলাম বিল্ডিংএর ছাদে, খোলা মাঠে সবজায়গায় হেলিকপ্টার নামানো যায়। বাপরে! যদি তাই হয় তবে আমাদের ছাদে কেন একদিন নামে না। জানি না।

এই প্রশ্নটা আবারও জেগে উঠেছিল যখন জানলাম, কোন কোন বিল্ডিংএর ছাদে হেলিপ্যাড থাকে, হেলিকপ্টার নামার জন্য। বিশেষ করে সিটি সেন্টার গড়ে উঠছে যেখানে নাকি হেলিপ্যাড থাকবে! কি আশ্চর্য, হেলিকপ্টার যেখানে সেখানে নামতে পাড়লে আবার হেলিপ্যাড দরকার হয় নাকি?

তারপর একদিন জানলাম, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নামের বিখ্যাত চিত্রশিল্পি হেলিকপ্টারে ড্রইং করেছিলেন, অথচ হেলিকপ্টার তৈরী হয়েছে তারও কয়েক শত বছর পরে। বড় অদ্ভুত সে ঘটনা, এ কখনোও হয় নাকি?

তখন যথেষ্ট বড় হয়েছি, বাসায় অাব্বা কম্পিউটার কিনে দিলেন। সেখানে পেলাম হেলিকপ্টার গেমস। সারাদিন পাগলের মত ডুবে থাকলাম গেমসে। হেলিকপ্টার চালানোর এই আনন্দ তো আর পাওয়া যাবেনা। একদিন এই মোহ কাটল।

এবার ধরল সিনেমার মোহ। হলিউডের মুভি দেখতে লাগলাম ধুমসে। প্রায় মুভিতেই হেলিকপ্টার। একটা দুটো না, আরও বেশী, প্রয়োজনে দু তিনটি ধ্বংস করতেও তাদের কোন আপত্তি নেই। সে তুলনায় বাংলা সিনেমা বড় বেশী নিরস, কোন হেলিকপ্টারই নেই। ভিয়েতনাম যুদ্ধের উপর হলিউডের মুভি গুলো তো আমাকে নতুন স্বপ্ন দেখালো । পাহাড়ের নিচ থেকে যখন হেলিকপ্টারগুলো সার বেধে উড়ে আসে, তখন তাদেরকে কি ভয়ংকর সুন্দর দেখায়। বাংলাদেশী সিনেমায় অবশ্যই এরকম দৃশ্য থাকা উচিত, তবেই না মানুষ দেখতে যাবে – এই ধরনের চিন্তা আমার মাথা থেকে দূর করা সম্ভব হয়নি।

একদিন খবর পেলাম বাংলা সিনেমায় হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে। ছুটলাম। দেখার আগেই হতাশ হয়েছি। এ যে ছোট্ট প্রাইভেট হেলিকপ্টার, এ দিয়ে আর কি হবে? সুতরাং আগ্রহ মারা গেল।

বাসায় একজন টিউটর ছিল, তখন ক্লাস এইটে পড়ি। তার সাথে তো একদিন আমার বিশাল তর্ক। হেলিকপ্টার দু প্রকার – একটা সরাসরি নামতে পারে, তার চাকা নাই, আর অন্যটার চাকা আছে, সরাসরি নামতে পারেনা । আমার স্যার যতই বোঝাতে চেষ্টা করেন না কেন, আমি হারিনি। এখন হাসি পায়।

একসময় ঢাকায় চলে এলাম। এখানে দেখি এলাহি কারবার, আকাশে সারাদিনই হেলিকপ্টার যাওয়া আসা করে, চক্কর দেয়। দিনে দেয়, রাতেও দেয়। সারাদিন গুড় গুড় শব্দ। ডান থেকে বামে, উত্তর থেকে পশ্চিমে। আমিও খুজে বেড়াই, যতক্ষন দেখা যায় তাকিয়ে থাকি। বুঝতে চেষ্টা করি এটাই আগের দেখা সেই হেলিকপ্টারটা কিনা!

সেদিন এক লজ্জার সিচুয়েশনে পড়ে গেলাম। খাওয়া শেষে ফিরছি, হঠাৎ হেলিকপ্টারের আওয়াজ, মনে হচ্ছে অনেক নিচ দিয়ে যাচ্ছে। আমি সব ভুলে দাড়িয়ে পড়লাম, অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে খুজলাম, কিন্তু পাওয়া গেল না। হতাশায় ঠোট উল্টে নিচে তাকিয়ে দেখি, যে বয়টি প্রতিদিন আমাকে নাস্তা এনে দেয় সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষন লজ্জা লাগল, তাড়াহুড়ো করে সরে এলাম।

হেলিকপ্টার নিয়ে কেন যে এত প্রীতি সেটা আমার জানা নেই, একদিন সত্যিকারের হেলিকপ্টারে চড়ে দেখার ইচ্ছে আছে, হয়তো একদিন পূরন হয়ে যাবে অন্য সব ইচ্ছে গুলোর মতই। সেই দিনের অপেক্ষায় আছি।

এখানেই শেষ… …. আরেকটি হেলিকপ্টারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে … … …

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *