বঙ্গসীমান্তে শিহরিত সন্ধ্যা

বাচ্চাকালের কথা – স্কুলে যাই কি যাই না এমন সময়।

চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে চড়েছি। আব্বা-আম্মা-ভাইয়েরা। ট্রেন ছেড়েছে বিকেলে। কোথায় যাচ্ছি এখন সেটা মনে নেই – চাদপুর বা ঢাকা হবে। বাচ্চাকালের ট্রেন ভ্রমণ মানেই দুটো বিষয় অবধারিত। আম্মা ডিম সিদ্ধ করে বাসা থেকে নিয়ে যেতেন, ট্রেনে বসে সেই ডিমের খোসা ছিড়ে ডিমটা পেটে চালান করে দেয়া – এক। দুই, গন্তব্যে পৌছে ট্রেন থেকে নামার পর কোন এক অজানা কারণে আমার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগত। এমন সে ঠান্ডা যে দাতে দাতে ঠকঠক-কিড়মিড়। প্লাটফর্ম থেকে বের হয়ে বাইরে বেবীটেক্সীতে উঠে রওয়ানা হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা। এখন বড় বেলায় ট্রেন ভ্রমনই প্রায় বন্ধ, দাত কিড়মিড় বন্ধ হয়েছে অনেক আগে। হুটহাট করে যাই হেথায়-সেথায়, সেজন্য বাস লঞ্চই ভরসা।

যা বলছিলাম – ট্রেনে চড়ে বিকেলে রওয়ানা করেছি। ঘন্টা দুয়েক বাদে আম্মা তার ব্যাগ থেকে ডিম বের করে খোসা খুলে আমাদের হাতে দিচ্ছেন একে একে। আব্বা মাগরিবের সময় হয়ে গেল বলে অযু করে এসেছেন, এখনি কোন একটা বেঞ্চে বসে বা দাড়িয়ে নামাজ পড়ে নিবেন – সেই সময় হঠাৎ আমি উত্তেজিত হয়ে আব্বাকে ডেকে বললাম – আব্বা আগুন ! আমার উত্তেজনা কাউকেই ছোঁয় নি, আব্বা মাথা নিচু করে দূরে পাহাড়ের গায়ে আগুনের কুন্ডুলি দেখলেন, তারপর বললেন – “ওইটা বর্ডার। বর্ডারের ওই পাশে ইন্ডিয়া। আগুন জ্বলে ইন্ডিয়াতে।” ওটা এমন একটা সময় যখন সব বাচ্চারাই তাদের বাবাকে পৃথিবীর সবচে’ জ্ঞানী মনে করে – আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। আমি আমার ‘সবচে জ্ঞানী বাবা’র কথায় বিশ্বাস রেখে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দূরের আগুনের কুন্ডুলীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হল, অন্ধকার বাড়ল। একটা আগুনের কুন্ডুলী ছাড়িয়ে আমি আরও অনেকগুলো আগুন দেখলাম – আর মনে মনে ভাবলাম – বাপরে, এইটুকু হাটলেই ইন্ডিয়া! এই জায়গার মানুষগুলো কতই না ভাগ্যবান !!

সেই দিন এখন আর নাই। এখন বর্ডারের মানুষগুলোকে সবচে দুর্ভাগ্যবান মনে হয়। এই লোকগুলা অল্পতে ধনী হবার দুর্দান্ত আগ্রহে বর্ডারের এপারের মাল ওপার আর ওপারের মাল এপার করে। একা করে না, পারলে পরিবার-পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়া করে। এইটা শুধু এই দেশের লোকেরা করে না, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বর্ডারের লোকজন কম বেশী এই কাজে লিপ্ত, ওইপারে যে ইন্ডিয়া, তারাও এই কাজ থেকে দূরে নাই। কিন্তু সমস্যা হল, মরে শুধু এ দেশের লোকেরাই। তারা বর্ডারে মরে, বর্ডারের পাশের ধানক্ষেতে মরে, দাড়ায়া মরে, শুইয়া মরে, কাটাতারে ঝুইলাও মরে। হঠাৎ মরে, ধুকে ধুকে মরে। বাচ্চা মরে, বুড়াও মরে। নারী মরে, পুরুষ মরে। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত বোধহয় আর কখনো সীমান্তে হত্যার ব্যাপারে এমন প্রতিবাদের ঝড় উঠে নি। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ট্রেন চালু হবার তিনদিনের মধ্যেও দুটো হত্যা হয়েছে। আগে খবর পাওয়া যেত পত্রিকার পাতায়, এখন নির্যাতনের ভিডিও পাওয়া যায় মোবাইলে-ল্যাপটপে। এখন বর্ডার মানে একটা ভীতিকর জায়গা।

নেত্রকোনা ভ্রমনের শেষ প্রান্তে ছিল বর্ডার ভ্রমন। দুপুরের পর থেকেই এই নিয়ে উত্তেজনা। উত্তেজনার প্রকাশ পায় বর্ডার নিয়ে হাসি তামাশায়। যে বাসে করে ঢাকায় ফিরবো তাদেরকে পাওয়া গেল শহরেই। সুতরাঙ বাস চলল সীমান্তে। কিছুদুর যাওয়ার পরে জানা গেল বাসচালক সীমান্ত চিনেন না, কারণ ওই দিকে তার যাওয়া হয় না। তবে তিনি জেনেছেন – সামনে চাররাস্তার মোড়ে গিয়ে বাম দিকে যেতে হবে। সেই মোতাবেক, এক চার রাস্তার মোড়ে থেমে এক মধ্যবয়সী লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করা হল – বর্ডার কি এই দিকে? ভদ্রলোক বেশ আগ্রহের সাথে জানালেন তিনিও ওই দিকেই যাচ্ছেন। সুতরাং তাকে গাড়িতে তুলে নেয়া হল। গাড়ি তার ডিরেকশনে চলতে লাগল। দশমিনিট যাবার পর আমাদের হুশ হল। বাসে মিনিট পাচেক লাগার কথা, সেখানে দশমিনিট লাগবে কেন? গাইড ভদ্রলোক জানালেন আরও মিনিট বিশেক গেলে তবেই বর্ডার। বোঝা গেল আমরা ভুল পথে চলে এসেছি। কিন্তু উপায় নাই, কারণ তার কথানুযায়ী, যতটুকু এসেছি ততটুকু সামনেই বর্ডার। ওখানেও লোক যায় বেড়াতে। মিনিট বিশেক পরে তিনি বাস থেকে নেমে যেতে যেতে জানালেন – ওই রাস্তা ধরে আরও পাচ মিনিট গেলেই বর্ডার। পাচ মিনিট শেষ পর্যন্ত বিশ মিনিটে দাড়ালো এবং আমরা কলমাকান্দার লেঙ্গুরা বাজারে পৌছুলাম।

ভদ্রলোক কেন এমন করলেন? তিনি ইচ্ছে করে করেছেন এমনটি বিশ্বাস হয় না। তিনি বর্ডারের কাছাকাছি থাকেন যেখানে পৌছুতে তার ত্রিশ টাকা লাগত। আমরাও বর্ডারে যাচ্ছি, সুতরাং তিনি বিনে পয়সায় চলে এলেন আমাদের সাথে। সমস্যা হল, তার কাছে বর্ডার মানে হল সারা বাংলাদেশের যে কোন বর্ডার, আর আমরা নির্দিষ্ট এক জায়গায় যেতে চাচ্ছি, যে কোন বর্ডারে না। ফলে তিনি তার বাড়ির কাছাকাছি এক বর্ডারে নিয়ে এসেছেন।

লেঙ্গুরা বাজারের কাছেই বিজিবি’র ক্যাম্প। তার পরে রাস্তা ধরে হাটলে বর্ডার। কিন্তু সেই রাস্তার মাঝে বিশাল গর্ত, রিঙ স্লাব বসানো হচ্ছে। তাই আমরা একটা টেম্পো ভাড়া করে ভিন্ন রাস্তায় রওয়ানা করলাম। সে এক অভিজ্ঞতা বটে। গাড়ির ভেতরে আমরা বারোজন, বাইরে ঝুলন্ত অবস্থায় তিনজন – সে একটা অবস্থা বটে। নিজের সিটে বসে থাকার জো নেই, এ মাথা থেকে সে মাথায় ছুড়ে ফেলছে যেন। বর্ডারের কাছাকাছি জায়গায় বাজারে আমরা গাড়ী থেকে নামলাম। বলা হল, ধূলোর রাস্তা ধরে এগুলেই বর্ডার। আমরা সারি বেধে রওয়ানা হলাম।

‘বর্ডার পার হয়েন না যেন – সাবধান’ – শুরুতেই এক দোকানে বসে থাকা কিছু মুরুব্বীদের একজন আমাদের উদ্দেশ্য বলল। আমরা ‘অবশ্যই’ বলে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েই বুঝলাম, বাজারের পরে আর কোন লোক নেই এই রাস্তায়। সুতরাং কোনটা বর্ডার, কোনটা না সেটা বোঝার উপায় নেই। একটু এগোই, কিছু সময় দাড়িয়ে থাকি। দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি ওইটাই ভারত কিনা। ফিরে আসছিল এমন দুজনকে জিজ্ঞেস করলাম -বর্ডার কোনটা? তারা বলল, সামনে মাজারের পরেই বর্ডার। আমরা এগুতে লাগলাম, কিন্তু কোন মাজার চোখে পড়ল না। তাহলে কি পেছনে ফেলে এলাম। যদি তাই হয়, তবে আমরা এখন নো ম্যানস ল্যান্ডে অথবা ভারতে! বড় ভাইদের একজনের কথায় দাড়িয়ে পড়লাম। না জেনে সামনে যাওয়া ঠিক হবে না। বাজারে নাকি কেউ বলেছিল – কিছুদিন আগে এরকম কিছু ছাত্র বর্ডারে গিয়ে আটকা পড়েছিল। তার মানে আমরা যে কোন মুহুর্তে বিএসএফ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি। আমাদের পোষাক দেখেই বোঝা যায় আমরা লোকাল না, সেক্ষেত্রে লোকালদের সাথে যে আচরন হবার কথা আমাদের সাথে তা হবে না। যদি বিএসএফ আক্রমন করেই ফেলে আমাদের কিছু করার নেই। কোন বিজিবি ক্যাম্প চোখে পড়ে নি, অথচ টেম্পো থেকে নামার পরে প্রায় এক কিলো দূরে চলে এসেছি। আমরা রিপোর্ট করে আসিনি, অর্থাত কেউ জানে না। আমাদের খোজ করতেও কেউ আসবে না। রাস্তার এক পাশে ধানক্ষেত। অন্যপাশে একটা পাহাড়ী নদী। বলে দিয়েছে ভুলেও যেন নদী পার না হই। কারণ কোন এক জায়গা নদীর এপারটাও ভারতে পড়েছে। খুবই খারাপ অবস্থা।

এবার আমরা থেমে গেলাম। বড় ভায়েরা বললেন না জেনে আর আগানো ঠিক হবে না। পাহাড়ে চড়ার ইচ্ছাটার অপমৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় নেই। দূরে ধানক্ষেতে এক পিচ্চিকে দেখা গেল। বর্ডার কোনটা সেটা জানার জন্য তাকে ডাক দেয়া মাত্র সে দিল ছুট- এক ছুটে হাওয়া। আমরা আরও দমে গেলাম। ফিরে যাবো কিনা সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পাহাড়ে না চড়ে কারও যাবার আগ্রহ নেই। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক ভাই জানালেন – হয়তো আমরা পাহাড়ে চড়তে পারবো না। কারণ আর কিছুই নয়, ওগুলো ভারতের দখলে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া প্রায় সব সীমান্ত অঞ্চলের পাহাড়ই ভারতের দখলে। কোন কোন ক্ষেত্রে পাহাড়ের দখল নেয়ার জন্য ভারতের সীমানা বাংলাদেশের ভেতরে এসে তারপর পেছেনে ফিরেছে, কিন্তু দখল নিয়েছে পাহাড়ের। ১৯৪৭ এ পাকিস্তান যখন নিজেদের জন্য একটা রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে বগল বাজাচ্ছিল, ভারত তখন দূরদর্শী হিসেবে সম্পদগুলো তাদের কব্জায় নিয়েছে। আমরা যে আগ্রহ নিয়ে পাহাড় দেখতে আসছি তা বাংলাদেশের সীমানায় যদিও পড়ে তবে তা পাহাড় না, পাহাড়ের সামান্য অংশ মাত্র। মূল পাহাড়টা ভারতেই রয়ে গেছে।

হঠাত দেখা গেল দুজন লোক আসছে, লোকাল মানুষ। কাছে আসতে দেখা গেল তারা আর কেউ নয়, আমাদের টেম্পো চালক এবং তার বন্ধু। আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম। তারাই জানালেন, মাজারটা আরেকটু সামনে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হওয়া কিছু মানুষের কবর একসাথে। কবরগুলো পড়েছে জিরোপয়েন্টে। এ পাশে বর্ডার পিলার, ও পাশে ভারত। তাদের সাথে সাথে আমরা এগোলাম। এবার দেখা গেল বিএসএফ এর চেকপোস্ট – নদীর ওপারে। তারপর দেখা গেল কাটাতারের বেড়া। অন্যদের দেখানোর সময় কেউ হাত তুলল না, মুখ দিয়ে দেখিয়ে দিল। যেন হাত তুললেই বিএসএফ এর গুলি আমাদের বুক এফোড় ওফোড় করে দেবে। তারপর দেখা গেল সীমান্ত পিলার। আর শহীদদের কবর।

সন্ধ্যা হয়ে গেলে আমরা ফিরলাম। টেম্পোর কাছে এসে বাজারের সাথেই একটা মাদ্রাসায় গেলাম সবাই। ছোট বাথরুম সারা, হাত মুখ ধোয়া এবং যাদের ইচ্ছা মাগরিব পড়ে নেয়া – এই হল উদ্দেশ্য। ছোট ছোট হুজুর এরা কোথা থেকে যেন ছুটে এল। এসেই আসসালামু আলাইকুম বলে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক। তারপর কেউ বদনায় পানি এনে দেয়া, দুইজন প্রতিযোগিতা করে টিউবওয়েল চেপে দেয়া ইত্যাদি করতে লাগল। ভালো লাগছিল তাদের ব্যবহার। কিন্তু অবাক হবার বাকী ছিল আরও। মসজিদে ঢোকার পর দেখা গেল তারা পড়ছে। আমাদের জায়গা করে দিল। নামাজ শেষ করে বের হওয়ার পথে এক এক করে ছুটে আসতে বাচ্চারা। আসসালামু আলাইকুম এবং হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক। ব্যাস আর কিছু নয়। তারপর আবার পড়তে বসা। অন্তত: পনেরোটা বাচ্চার সাথে ওয়ালাইকুম আসসালাম এবং হ্যান্ডশেক করতে হল। বর্তমান সময়ে সালাম দেয়ার প্রচলন শুধু মুরুব্বীদের জন্য সীমাবদ্ধ হয়েছে। ‘হ্যালো’ বা ‘হাই’ সালামের জায়গা দখল করে নিয়েছে। বন্ধুদের মধ্যে সালাম দিলে কেউ হয় বোকা, কেউ হয় মৌলভী। এই শিশুদের আচরন ঘন্টাখানেক আগের ভীতিকর মানসিক অবস্থার কথা ভুলিয়ে দিল।

বিএসএফ যদি হয় জাহান্নামের প্রহরী, এই শিশুরা তবে নিশ্চয়ই জান্নাতের টুকরো। শান্তির পরশ বুকে নিয়ে আমরা ফিরে চললাম। কাল থেকে আবার গোলামী শুরু। সো, গুডবাই নেত্রকোনা।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *