‘ঈদের দিন’ যে মাত্র তিনদিন নয় বরং পাঁচ থেকে সাত দিন কিংবা আরও বেশী, সেটা বুঝতে আমাদের বাঙ্গালীর একটু সময় লেগেছিল বটে। দেরীতে হলেও এই ’বুঝতে’ পারার জন্য যারা সাহায্য করেছে সেই প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলোকে ধন্যবাদ না জানানো অকৃতজ্ঞতার নামান্তর। বর্তমানে ঈদের চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম দিন পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়, যা অনেকটা নির্ভর করে চ্যানেলগুলোর সামর্থের উপর। গত ঈদ উল আযহাতে এই ঈদের দিন পাঁচ থেকে সাতদিন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং অবশ্যই এই বিস্তৃতি বোঝা যায় ঈদের অনুষ্ঠানমালার (বিশেষ) মাধ্যমে।
১৯৯৭ সালের পূর্বে এই মিডিয়া জগতে বিটিভির একক আধিপত্য ছিল, তাই অন্যান্য অনুষ্ঠানের সাথে তুলনা করার সুযোগ ছিল না এবং সত্যি কথা বলতে, ভালো অনুষ্ঠান বলতে কোন ’তুল্য’ অনুষ্ঠানের ধারনা দর্শকদের ছিল না। পরবর্তীতে স্যাটেলাইট চ্যানেলের আগমনে আরও টিভি চ্যানেল তাদের প্রচার কার্যক্রম শুরু করে এবং দর্শক বিটিভির একক থাবা থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের পছন্দ অনুযায়ী অনুষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষমতা গ্রহন করে। যদিও এই ক্ষমতা কতিপয় সীমিত মানুষের করায়ত্ত ছিল, তথাপি একে সাধুবাদ জানানো যায়। এবং এর মাধ্যমেই দর্শক তুলনামূলক ভালো অনুষ্ঠানের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ লাভ করে এবং প্রতিযোগিতার প্রভাবে অলিখিত ভাবে ঈদের আনন্দ তিন থেকে ছ’/সাত দিনে উন্নীত হয়।
এই বিস্তৃতির কিছু ভালো দিক রয়েছে, রয়েছে খারাপ দিকও। ভালো মানের অনুষ্ঠান তৈরী হচ্ছে, দর্শকদের বিনোদিত হবার সুযোগ বাড়ছে, নতুন নতুন নির্মাতারা এগিয়ে আসছেন, বিনোদন সেক্টর সমৃদ্ধ হচ্ছে। তবে এই সুযোগে মানহীন কিংবা নিম্নমানের অনুষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়ছে। বর্তমানে যেহেতু সিরিয়াল আর মেগা সিরিয়ালের যুগ চলছে, তাই এই বিশেষ দিনগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি দেখা যায়। ঈদের সকল বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটি নির্দিষ্ট ফরম্যাট লক্ষ্যনীয়। নাটক, সিনেমা এবং টেলিফিল্মের পাশাপাশি টক শো, গেম শো, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ঈদের বেশীর ভাগ টকশো তারকাদের নিয়ে। ফলে বরাবরের মতো এবারও প্রায় সব চ্যানেলেই তারকাদের নিয়ে নানা ধরনের টকশোর আয়োজন ছিল। ছোটপর্দার অধিকাংশ তারকার সাথে বড় পর্দার সীমিতসংখ্যক তারকা/ তারকা-দম্পতি, সঙ্গীত শিল্পীদেরকে নিয়ে টকশো গুলো নির্মিত হয়। অনেক হাসিখুশীর এবং মজার আড্ডাবাজির এই অনুষ্ঠানগুলো দর্শকপ্রিয়।
এই ঈদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সব চ্যানেলই । চ্যানেল আইয়ে ঈদের দ্বিতীয় ও তৃতীয়দিন প্রচারিত ’সম্পাদকের ঈদ’ ও ’ব্যবসায়ীর ঈদ’ এ ধরনের একটি ভিন্ন প্রয়াস। অবশ্য রাত দুটোয় প্রচারিত এই অনুষ্ঠানের দর্শক বোধহয় ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত শহুরে দর্শক ছাড়া আর কেউ নন! এটিএন বাংলায় ঈদের আগের রাতে প্রচারিত ’রম্যরস’ আরেকটি ভিন্ন স্বাদের অনুষ্ঠান। পেশাজীবি ডাক্তারদের নিয়ে নির্মিত এ ধরনের অনুষ্ঠান এই প্রথম। তবে সবচে’ ভিন্নতা দেখিয়েছে একুশে টেলিভিশন এবং এনটিভি। তারা ঈদের অনুষ্ঠানমালায় যোগ করেছে ভারতীয় অনুষ্ঠানমালা।
একুশে টেলিভিশনে টিংকু আজিজুর রহমানের পরিচালনায় অভিজিৎ সানওয়ান্তের হিন্দী গানের কনসার্ট আর রাভিনা ট্যান্ডনের ড্যান্স পার্ফম্যানস ঈদের অনুষ্ঠানমালায় স্থান পাবার ব্যাপারে কতটুকু যোগ্যতা সম্পন্ন ছিল সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা যায়। কিছুদিন আগেই দেশে এই দুই ভারতীয় শিল্পী দেশীয় দর্শকদের বিনোদিত করে গিয়েছিলেন। সে সময় ধারনকৃত এই অনুষ্ঠানটি দুটো ভাগে দু’দিন দর্শকদের জন্য প্রচার করা হল। এনটিভি এ ব্যাপারে আরও এক ধাপ এগিয়ে। তারা ঈদের দিনই প্রাইম টাইমে প্রচার করেছে বলিউডের খ্যাতিমান অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের এঙ্ক্লুসিভ সাক্ষাতকার। পরদিন সাইফ আলী খান, সালমান খান, বিবেক ওবেরয় আর কারিনা কাপুরের সাক্ষাতকার নিয়ে বিশেষ ’হট’ অনুষ্ঠান ’বলিউড ফোর’। নিঃসন্দেহে তারা সবাই এদেশের দর্শকদের প্রিয় সেলিব্রেটি। কিন্তু বাংলাদেশের ঈদের অনুষ্ঠানে স্থান পাবার মত গুরুত্বপূর্ন কি, বিশেষ করে যেখানে বাংলাদেশে এধরনের গুরুত্বসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ এখনো বিদ্যমান।
এছাড়াও প্রায় সব চ্যানেলেই স্থান পেয়েছে ফ্যাশন শো। বিশেষ করে একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত বাটেপো ফ্যাশন শো অনুষ্ঠানে দ্রষ্টব্য কি, সে ব্যাপারে সন্দেহ তৈরী হয়। দেশী মডেলদের দিয়ে বিদেশী পোষাকের প্রচারনা কিছু পাঁচতারা হোটেলের বলরুমেই মানায়, টেলিভিশনের মতো মাস মিডিয়ায় এই প্রচারণা কাম্য নয়। পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে একুশে টেলিভিশন যে যাত্রা শুরু করেছিল, তারা কোন ধরনের পরিবর্তনে বিশ্বাসী সে ব্যাপারে প্রশ্ন জাগতেই পারে। আশা করা যায়, পরবর্তী ঈদের অনুষ্ঠান নির্বাচনে তারা মনযোগিতার পরিচয় দেবে।
প্রায় সব চ্যানেলই তাদের প্রতিদিনের ঈদের অনুষ্ঠানের তালিকায় একটি করে বাংলা সিনেমা প্রচারের ব্যবস্থা রেখেছে। এ ব্যাপারে ভিন্নতা দেখিয়েছে দিগন্ত টেলিভিশন। প্রথম দুই দিন তারা বাংলা ডাবিংকৃত ইরানের দুটি ভালো চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছে। বিশ্ব চলচ্চিত্রকে দর্শকের সামনে তুলে ধরে নৈতিকতায় আগ্রহী করার প্রয়াসের জন্য তারা বাহবা পেতে পারে, তবে একই সাথে হয়তোবা নিন্দনীয় হবে বাংলা সিনেমার তুলনায় বিদেশী চলচ্চিত্রকে গুরুত্ব প্রদান করায়।
প্রতিযোগিতার এই বাজারে সামনে আরও দশ-বারোটি টিভি চ্যানলে যুক্ত হবে শীঘ্রই। একে আমরা সাদরে আমন্ত্রন জানাই কিন্তু একই সাথে আশংকাও করি, হিন্দী চ্যানেলগুলোর ভীড়ে বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো দেখার জন্য আমরা যখন রিমোট হাতে নিই, তখন হয়তো এই দেশী চ্যানেলগুলোও হিন্দী অনুষ্ঠানের আগ্রাসন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। বাণিজ্যিক সাফল্যের উর্দ্ধে দেশপ্রেম স্থান পাবে – এই বিশ্বাসে নিজেকে আশংকামুক্ত রাখার চেষ্টা করি।
এই মন্তব্য প্রতিবেদনটি সোনারবাংলাদেশ এ ছাপা হয়েছিল