সত্যাজিতের অপরাজিত

অপু ট্রিলজির সেকেন্ড পর্ব অপরাজিত, যার ইংরেজি দ্যা আনভ্যাংকুইশড, ট্রিলজির গুরুত্বপূর্ন পর্ব হওয়া সত্বেও ততটা দর্শকপ্রিয় হতে পেরেছে বলে জানা যায় না। পথের পাচালি নিয়ে যত মাতামাতি হয়, অপরাজিত সেভাবে আলোচনায় স্থান পায় না। অথচ, পথের পাচালি এবং অপুর সংসার – এ দুয়ের মাঝে সংযোগ তৈরীর কাজটি করেছে অপরাজিত । আরও পরিস্কার করে বললে, অপরাজিতের মাধ্যমেই সত্যাজিত এই ট্রিলজি তৈরী করতে পেরেছিলেন। অন্যথায়, পথের পাচালি এবং অপুর সংসার দুটোই দুটি স্বাধীন এবং একক মুভি হতে পারতো। এবং একক মুভি হিসেবে অপরাজিত খুব অতৃপ্তি নিয়ে শেষ হয়, অবশ্য এ দর্শকদের নিজ নিজ বিবেচনার মধ্যে পড়ে। হয়তো এ কারনেই পথের পাচালি দেখেছে এমন দর্শকদের মধ্যে একটা বিশাল অংশই অপরাজিত দেখেনি।

পথের পাচালি যেখানে যেখানে শেষ হয়েছে তার পরবর্তী অংশই অপরাজিত। সেই নিশ্চিন্তপুর ছেড়ে এসে বেনারসে এসে সামলে নিচ্ছেন হরিহর আর সর্বজয়া, এর মাধ্যমেই অপরাজিতের শুরু। একদম শুরুর সিকোয়েন্স গঙ্গাঘাটের নানাবিধ বিচিত্র কার্যাবলীর এক বিস্তারিত কিন্তু পরিমিত বর্ননা পাওয়া যায়। হরিহর (কানু ব্যানার্জি) গঙ্গাঘাটে পুরুতের কাজ করে সামান্য পয়সা উপার্জন করে, পাশাপাশি চলে কবিরাজির চর্চা। আর অপুর টৈ টৈ।

এর মাঝে কোন একদিন হরহরের জ্বর এবং পরবর্তীতের মৃত্যুতে একমাত্র ছেলে অপুকে নিয়ে বিশাল দায়িত্ব পালনের জন্য ঘরে কাজ নেন সর্বজয়া। কিন্তু পাশাপাশি ছেলেকেও একই কাজে নিয়োজিত দেখে সর্বজয়ার আত্মমর্যাদাবোধ জেগে উঠে এবং তিনি কাজ ছেড়ে তার আত্মীয়ের গ্রামে এসে উঠেন। অপু পুরুতের কাজ শিখে নেয়। ছেলের আগ্রহে অপুকে স্কুলে পাঠান সর্বজয়া, ছেলে পাশ করে শত সমস্যা সত্ত্বেও কলকাতা যায় উচ্চশিক্ষার্থে, বাড়ীতে একা পড়ে রয় সর্বজয়া। আশায় আশায় দিন কেটে যায়, শরীর খারাপ হয়, অন্যদিকে পড়াশোনার চাপ আর কলকাতা ছেড়ে মা’র কথা ভাববার সময়ই পায় না অপু। একসময় সর্বজয়া মারা যায়, অপু ফিরে আসে, সব গুছিয়ে কলকাতার দিকে রওয়ানা করে সকল পিছুটান ভুলে।

মা আর সন্তানের সম্পর্ক আর দ্বন্দ্ব – এই নিয়েই ছবির থিম। সর্বজয়ার চরিত্রে করুনা ব্যানার্জি খুব ভালো অভিনয় করেছেন, নি:সন্দেহে। ছবিতে দুটো মৃত্যু, হরিহর এবং সর্বজয়া, দুটোই বড় চরিত্র, তারপরও বাহুল্য মনে হয়নি কোথাও। সর্বজয়ার মৃত্যুর পূর্বে গাছের তলায় শুয়ে থাকা এবং হ্যালুসিনেশনের মধ্যে অপুর ডাক শুনে খুজতে গিয়ে পুকুরের উপর ঝাকে ঝাকে জোনাকি পোকা – সে এক অসাধারন দৃশ্য। অন্ধকারের মধ্যে জোনাকি পোকা তৈরীর দৃশ্যটা নি:সন্দেহে সেই সময় খুব টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জ ছিল।

ঠোটের উপর সদ্য গজানো গোফ নিয়ে অপু চরিত্রে স্মরন ঘোষাল খুব ভালো অভিনয় করেছে। তার পাকা অভিনয় তার চরিত্র এবং ঘটনা প্রবাহকে খুব মসৃণভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সত্যাজিতের অন্যন্য ছবিগুলোর মতই এখানেও পরিবার এবং সমাজ বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যাশিক্ষা এবং কো-কারিকুলার শিক্ষার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ তৈরী করার প্রচেষ্টাগুলো অনুসরনীয়। আলাদাভাবে মুভিটি দেখলে খুব বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে বিশেষ করে পথের পাচালির কাহিনী জানা না থাকলে, নিজের কৈশোরকালকে ফিরে দেখতে একবার হলেও অপরাজিত দেখা যেতে পারে।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *