সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের দুই গোয়েন্দা

গোয়েন্দা

বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দাদের সকলের সাথে কম বেশি পরিচয় থাকা উচিত – এমন একটা ধারণা থেকে বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দাদের খোঁজ খবর শুরু করেছিলাম কয়েক বছর আগে থেকে। এ বিষয়ে ‘ক্রাইম কাহিনীর কালাক্রান্তি‘ একটা সম্পদ। এখানে গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত প্রায় সকল গোয়েন্দার – বাংলাভাষী ও বিদেশী – সংবাদ তুলে ধরা হয়েছে৷ এ সকল গোয়েন্দার পরিচয় জানার পরে উপলব্ধি করলাম – এত গোয়েন্দার সাথে সাক্ষাৎ সম্ভব নয় বরং জনপ্রিয় গোয়েন্দাদের সাথে পরিচিত হওয়া বেহতর। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের দুই গোয়েন্দার সাথে পরিচয় এভাবেই।

এই দুই গোয়েন্দার মধ্যে একজন হলেন গোয়েন্দা কর্নেল নীলাদ্রি চৌধুরী। তিনি সামরিকবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এবং শখের গোয়েন্দা। তবে তার খ্যাতির ব্যাপ্তি বহুদূর। পুলিশের উচ্চ, মধ্য ও নিম্নস্তরের অনেক কর্মকর্তার সাথে সরাসরি পরিচয় রয়েছে, তারা নির্দ্বিধায় তার সাহায্য গ্রহণ করেন। পত্রিকার পাতায় তার রহস্যভেদের গল্পগুলো প্রকাশের ফলে সাধারণ মানুষের কাছেও তিনি অচেনা নন।

অন্যজন পুলিশের গোয়েন্দা। তার নাম ইনস্পেকটর সুরপতি ব্রহ্ম, পরিচিত ইনস্পেকটর ব্রহ্ম নামে। তিনি আগে কলেজের অধ্যাপনার সাথে যুক্ত ছিলেন, চাকরী ছেড়ে পুলিশের গোয়েন্দা হয়েছেন এবং দ্রুত সাফল্যের শীর্ষে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। যেহেতু পুলিশের কর্মকর্তা, রহস্য সমাধানের দায়িত্ব তার কাঁধে ‘অফিসিয়ালি’ ন্যস্ত হয় এবং এ কাজে তিনি বাহিনীর সহায়তা পান, কেবল চাহিদা জানাতে পারলেই চলে।

এই দুই গোয়েন্দার মধ্যে গোয়েন্দা কর্নেল বেশী পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দাদের তালিকায় তার নাম একটু নীচের দিকে হলেও বয়সে অপেক্ষাকৃত প্রবীণ৷ মানে, তিনি একজন বৃদ্ধ গোয়েন্দা। দৌড়-ঝাপ, ছদ্মবেশ ইত্যাদির মাধ্যমে রহস্য সমাধান তিনি করেন না, কেবলমাত্র মগজ খাটান। প্রয়োজনে পুলিশের সহায়তা নেন। উচ্চতা ছয়ফুটের বেশি এবং মাথা টাক ও মুখ শুভ্র চুল-দাঁড়িতে ঢাকা বলে তাকে বিদেশী বলে ভ্রম হয়।

গোয়েন্দা কর্নেল চিরকুমার। তিনি প্রকৃতি পছন্দ করেন। পাখি ও প্রজাপতি দেখার নেশায় তিনি জঙ্গলে বেড়াতে পছন্দ করেন। তিনি যেখানেই যান সেখানেই তিনি কোন না কোন ঘটনার সাথে জড়িয়ে যান।

এরকম গোয়েন্দার একজন সহকারী থাকতে হয়। তার কাজ হলো রহস্য সমাধানের ঘটনা পাঠকের কাছে বর্ণনা করা। গোয়েন্দা কর্নেলের সহযোগী হলেন দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত৷ কর্নেলের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হলেও কর্নেল তাকে খুব পছন্দ করেন এবং সাথে রাখেন৷ অবশ্য, সাংবাদিক জয়ন্ত যে সবসময় কর্নেলের আচরণে সন্তুষ্ট থাকেন, তেমনটি নয়, কর্নেলের খেয়ালিপনা নিয়ে জয়ন্তের বিরক্তির প্রকাশ সব গল্পেই পাওয়া যায়।

তবে, সব গল্পেই জয়ন্ত কর্নেলের সহকারী নন। সেই গল্পগুলো উত্তম পুরুষে বর্ণিত। এ ধরণের গল্পগুলোতে কর্ণেলের পাশাপাশি অন্যান্যদের কর্মকান্ডের বর্ণনাও পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, ইনস্পেকটর সুরপতির ব্রহ্ম মাঝবয়েসী লোক, মোটাসোটা এবং রসিকতাপ্রিয় মানুষ। চাকুরীজীবি হওয়ার কারণে তাকে প্রতিনিয়তই খুনখারাপি নিয়ে থাকতে হয়। তার রয়েছে চায়ের নেশা এবং সর্দির ধাত। তার স্ত্রী সুরঞ্জনা সবসময় স্বামীর দিকে খেয়াল রাখেন। গোয়েন্দা হিসেবে তিনি স্বামীর চেয়ে গোয়েন্দা কর্নেলকেই বেশি পছন্দ করেন এবং তার গল্পের গুণমুগ্ধ পাঠক।

গোয়েন্দা কর্নেল এবং ইনস্পেকটর ব্রহ্মের মধ্যে তুলনা করা যায় না, কারণ দুটো দু ধরণের পাঠকের জন্য লিখিত৷ কিশোর ও তরুণদের কথা মাথায় রেখে গোয়েন্দা কর্নেল গল্পগুলো রচিত, বাজারেও এই বইয়ের দুই ধরণের গল্পসমগ্র পাওয়া যায় – গোয়েন্দা কর্নেল সমগ্র এবং কিশোর গোয়েন্দা কর্নেল সমগ্র। অন্যদিকে, ডিটেকটিভ ইনস্পেকটর ব্রহ্মের বইগুলো পরিণতমনস্ক পাঠকদের জন্য৷ এখানে মদ্যপানের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে, বিবাহিত নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্ককে স্বাভাবিক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

ব্রহ্মের গল্পগুলো অনেকটা টিভি সিরিয়ালের মতো৷ গোয়েন্দা কর্নেলের গল্পগুলো সে তুলনায় স্বল্প বা পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা। তৃপ্তিটাও বেশী পাওয়া যায় গোয়েন্দা কর্নেলে। এর প্রধান কারণ সম্ভবত গল্পের ঘটনা সংঘটনের স্থান। ব্রহ্মের সকল ঘটনাই তার কর্মক্ষেত্র অর্থ্যাৎ কলকাতায় সংঘটিত হয়। ওদিকে, কর্নেলের ঘটনা ঘটে বাংলা, বিহার, আসামসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। গল্পে সেই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনা ভিন্ন এক রসের যোগান দেয়। সংখ্যার দিক থেকেও গোয়েন্দা কর্নেল ব্রহ্মের তুলনায় অনেক এগিয়ে।

একদিক দিয়ে অবশ্য দুই গোয়েন্দা গল্পেই বৈচিত্র‍্যের ঘাটতি রয়েছে। তাদের শতভাগ রহস্যই খুনকেন্দ্রিক। খুনীকে ধরাই প্রধান কাজ, তবে পাশাপাশি কিছু রহস্যের সমাধানও হয়। গোয়েন্দা কর্নেল বলুন আর ইনস্পেকটর ব্রহ্ম – সব গল্পেই যে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট তা হলো – টেলিফোনের অভাব। শুধু এই এক বৈশিষ্ট্যের কারণেই গোয়েন্দা গল্পগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে আটকে থাকবে এবং সহজে সেখান থেকে মুক্তি পাবে না। ফেলুদার গল্পগুলোতেও টেলিফোনের ব্যবহার রয়েছে, কিন্তু টেলিফোনের অভাব সেখানে ঘটনাগুলোকে ততটা প্রভাবিত করে না, কিন্তু এই গোয়েন্দাগল্পগুলোতে টেলিফোন থাকলে অনেক ঘটনা রহস্যেই জমাট বাঁধবে না।

গোয়েন্দা কর্নেল এবং ইনস্পেকটর সুরপতি ব্রহ্ম চরিত্র দুটোর স্রষ্টা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করে এই লেখাটি শেষ করবো। তিনি সুনীল গাঙ্গুলি, শীর্ষেন্দু মুখার্জিদের সমসাময়িক লেখক। আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন এবং সে সূত্রে কলকাতা নিবাসী ছিলেন। তবে কৈশোরে থাকতেই তিনি নাচ-গান-অভিনয় ইত্যাদির সাথে যুক্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড, মুর্শিদাবাদের গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ফলে তার অভিজ্ঞতার ভান্ডার পরিপূর্ণ ছিল। এই অভিজ্ঞতার ছাপ তার গল্পগুলোতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধারার গল্প উপন্যাস লিখেছেন তিনি, পুরস্কার ও স্বীকৃতিও পেয়েছেন। তবে, গোয়েন্দা গল্পগুলো তার শ্রেষ্ঠ রচনার তালিকায় নেই।

পাঠককে মনে করিয়ে দেয়ার স্বার্থে বলছি, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালক মুরাদ পারভেজ দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন – চন্দ্রগ্রহণ এবং বৃহন্নলা। এর মধ্যে বৃহন্নলা সিনেমার জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছিলেন। পরে জানা যায়, তিনি চুরি করা গল্পে এই সিনেমাগুলো নির্মাণ করেছিলেন যার মূল লেখক আমাদের এই গোয়েন্দাগল্প লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, গল্পের নাম ‘গাছটা বলেছিল’। মুরাদ পারভেজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘চন্দ্রগ্রহণ’ও একই লেখকের গল্প অবলম্বনে নির্মিত।

ইনস্পেকটর ব্রহ্মের তুলনায় গোয়েন্দা কর্নেল পড়ে আমি বেশি তৃপ্তি পেয়েছি, আপনাদের কাছে দুটোই ভালো লাগতে পারে৷

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *