গল্প: ভদ্রতার খাতিরে

আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিমুল সদ্য বিয়ে করে ছোট্ট বাসায় সংসার পেতেছে। কদিন আগে আমরা দশ-বারোজন বন্ধু-বান্ধব সদলবলে তার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। মুরগির রোস্ট-গরু-পোলাও দিয়ে পেট ভরে খাওয়ানোর পর বন্ধু-পত্নী সবাইকে ছোট ছোট বাটিতে করে রসমালাই খেতে দিয়েছে। নতুন সংসারে চা চামচ বোধহয় বেশী নেই, একটা বাটিতে কাটা চামচ দিয়েছে রসমালাই খাওয়ার জন্য, সেটা আবার আমার ভাগেই পড়ল।

কাটাচামচ দিয়ে রসমালাইয়ের ডিমগুলো খাওয়া সহজ, কিন্তু মালাই খাবো কিভাবে? নতুন সংসার দেখার উছিলায় আমি হাতে মিষ্টির বাটি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। ঘরের এক কোনায় রাখা বুকশেলফের বই দেখতে দেখতে চট করে একবার আশেপাশে দেখে নিয়ে সুৎ করে টান দিয়ে মালাইটুকু খেয়ে ফেললাম। জিহবা দিয়ে বাটিতে লেগে থাকা মালাই চেটে নিয়ে পেটে চালান করে দিয়ে তাকিয়ে দেখি – শিমুলের নববধূ রান্নাঘরের দরজা থেকে আমার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে!

লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার দশা। ভদ্রতা বজায় রেখে মিষ্টির বাটি রেখে দিলেই হতো। আসলে ভদ্রতার খাতিরে আমাদের কত কিছুই না করা লাগে। চারজনকে পাঁচটি মিষ্টি খেতে দিলে ভদ্রতার খাতিরে একটি মিষ্টি রেখে দিতে হয়। চায়ের কাপে রাখতে হয় তলানী। ভদ্রতার খাতিরে খেতেও হয়, আবার মুখ বন্ধও করা লাগে কখনও কখনও। ভদ্রতা নিয়ে সেই কৌতুকটার কথা আরেকবার বলা যাক।

ছোট্ট খোকনকে তার আম্মু শিখিয়েছে – মেহমান হয়ে কোথাও গেলে যদি বিস্কুট খেতে দেয়, তাহলে সব খাওয়া যাবে না, একটি বিস্কুট রেখে দিতে হবে। কেন? কারণ, এটা ভদ্রতা। কিছুদিন পরে খোকনদের বাসায় বাসায় মেহমানকে এসেছে। তাকে চা-বিস্কুট খেতে দেয়া হয়েছে। মেহমান যখন শেষ বিস্কুটটি হাতে নিয়েছে তখনই ছোট্ট খোকন চিৎকার করে বলল, আম্মু! আম্মু! আন্টি ভদ্রতা খেয়ে ফেলল কিন্তু।

ভদ্রতা করে খাওয়া বন্ধ করার গল্প বললাম, মুখ বন্ধ করার গল্পটা বলি। অফিসের বড় কর্তার রুমে বেশ গালগপ্প চলছে, আমিও আছি। গল্পে গল্পে কর্তা বললেন, আমি নিশ্চিত গৌতম বুদ্ধকে তার বউ বাচ্চার পটি পরিস্কার করতে দিয়েছিল, এই শোকেই তিনি সংসারত্যাগী হয়েছিলেন। কর্তার এই কথায় সবাই হা হা করে তৈলাক্ত হাসি হাসতে শুরু করলেও আমি হাসতে পারলাম না। গৌতম বুদ্ধের মত একজন ধর্মগুরুকে নিয়ে হাস্যরস করা যে শিষ্টাচার বহির্ভূত, সেটা বলার জন্য মুখ খুলেও বন্ধ করে ফেললাম। কেন? সেই ভদ্রতার খাতিরেই।

আমাদের আরেক বন্ধু রাব্বী একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শক পদে চাকরী করে। পরিদর্শনের কাজে যেখানেই যায়, সেখান থেকেই নগদ টাকা-পয়সা ছাড়াও নানা রকম গিফট পায়। রাব্বীও দিলদরিয়া লোক, আশেপাশের মানুষের মধ্যে গিফট বিলিয়ে দেয়। সেদিন আমাকে ডেকে নিয়ে এক পিস স্যুটের কাপড় দিল।

‘হঠাৎ স্যুটের কাপড় দিচ্ছিস যে?’
‘এক ক্লায়েন্ট গিফট দিল। শুধু কাপড় দিলে হয়, বল? স্যুট বানাতে মিনিমাম দশ হাজার টাকা লাগে, সেটা না দিলে স্যুট বানাবো কিভাবে?’ – রাব্বী বেশ উদাস গলায় বলল।
‘চাইলেই পারতিস।’
‘ভদ্রতার খাতিরে চাইতে পারলাম না দোস্ত। আমার আবার এইসব চাইতে ইয়ে লাগে।’
‘আমার কিন্তু ইয়ে ফিয়ে নাই। স্যুট বানানোর টাকা নাহয় কদিন পরেই দিস। তদ্দিন কাপড়টা আলমারিতে তুলে রাখলাম।’
বেচারা রাব্বী। সে ভদ্রতার খাতিরে আমাকেও ‘না’ বলতে পারলো না। মাসখানেক পরে বিকাশ করে স্যুট বানানোর টাকা পাঠিয়ে দিল।

শান্তনুর ঘটনাটা বলে এই নিবন্ধ শেষ করি।

শান্তনু একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে। পোস্টিং ফেনীর বসুরহাটে। শুক্র-শনিবারে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসে। আমিও সেখানে ক্লাস করি, আর এভাবেই শান্তনুর সাথে পরিচয়। শান্তনু খুব লাজুক ছেলে। এই বয়সেও ক্লাসের স্যার-ম্যাডামদের সাথে মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, প্রেজেন্টেশনের সময় ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায়।

আমাদের দুই বছরের কোর্স শেষ হবার শেষের দিকে একটা ঘটনা ঘটে গেল। রাতের ট্রেনে চেপে ঢাকায় ফিরছিল সে। ভোরের দিকে সহযাত্রীর অনুরোধে একটি মাত্র বিস্কুট খেয়েছিল, তারপর টানা আঠারো ঘন্টার ঘুম। এর মাঝে রেল পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে দিয়েছে, সেখানে তার পেট ওয়াশ করা হয়েছে। পরের সপ্তাহ থেকে শান্তনু আবার ক্লাসে আসতে শুরু করল।

দেখা গেল, বিস্কুট খাওয়ার আগের শান্তনু আর পরের শান্তনুর মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। আমাদের লাজুক, মুখচোরা সেই শান্তনুকে রিপ্লেস করে বেজায় উৎফুল্ল এক শান্তনু আমাদের সাথে ক্লাস করতে লাগল। নতুন শান্তনু অল্পতেই হো হো করে হাসে, কোর্স টিচারের সস্তা কৌতুকে রীতিমতো টেবিল চাপড়ায়। তার সেই লাজ সঙ্কোচ কোথায় যে হারালো কে জানে। তার সুপার এ্যাকটিভ রোল দেখে মাঝেমধ্যে আমরাই বিব্রত হয়ে যাই। একদিন তো অল্পবয়সী কোর্স টিচারকে সবার সামনেই ‘ম্যাডাম আপনাকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে’ বলে ফেলল। ম্যাডাম না শোনার ভান করলেও মুখের লজ্জা রাঙ্গা ভাব লুকাতে পারলো না।

কোর্স শেষ হয়ে গেলে যে যার জায়গায় ফিরে গেল। মাস তিনেক পরে আমি একদিন ফোন দিলাম।
‘শান্তনু, আমি নাজমুল। কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘শান্তনু, আমাকে চিনতে পেরেছেন তো? আপনার সাথে কোর্স করলাম কিছুদিন আগে।’
‘ও নাজমুল! এবার চিনতে পেরেছি। কি খবর তোমার?’
‘আমাকে এখনও চিনেন নাই মনে হচ্ছে। আপনি তো আমাকে তুমি করে বলতেন না।’
‘মনে করতে একটু কষ্ট হচ্ছিল রে। এখন তোকে ঠিক চিনতে পারছি। তুই নাজমুল না? এক সাথে কোর্স করলাম… ‘

আমি মনের দুঃখে অল্প কথায় শেষ করলাম। শান্তনু আমাকে ‘তুই’ করে বলেছে এজন্য দুঃখ পাইনি। সে আসলে আমাকে চিনতে পারেনি। খুব রাগও হচ্ছিল। ভদ্রতার খাতিরে বিস্কুটটা না খেলে শান্তনুটাও আগের মতো থাকতো।

সব দোষ ভদ্রতার।

ছবি: অসামান্য ডট কম

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

2 Comments on “গল্প: ভদ্রতার খাতিরে”

Leave a Reply to দারাশিকো Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *