আলাস্কার নীলরঙা ম্যাজিক বাস

গাছের আড়াল থেকে বের হয়েই পরিত্যক্ত বাসটা চোখে পড়ল তার। শিকারি বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। বাসের আশেপাশের জায়গাটা পরিষ্কার, জানে এরকম খোলা জায়গায় লুকাবে না মুজটা। তখনই গন্ধটা নাকে এলো – কিছু একটা পঁচেছে। বাসের মধ্যে কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখতে গিয়ে লাশটা আবিষ্কার করলো শিকারি লোকটা – অল্প বয়সী একটি ছেলে, সম্ভবত খেতে না পেয়ে মারা গেছে। বাসটা ভালো করে দেখে নিল সে, ১৪২ নাম্বার। লোকেশনটা নোট করে নিল, লাশটা উদ্ধারে কাজে লাগবে। তারপর ফিরে চলল মুজ হান্টার। সময়টা সেপ্টেম্বর, ১৯৯২।

ঘটনাটাস্থান ডেনালি ন্যাশনাল পার্ক, আলাস্কা। বাসটা যেখানে রাখা আছে সেটা স্ট্যাম্পেড ট্রেইল বলে পরিচিত। ১৯৬০-৬১ সাল থেকে বাসটা এখানে আছে। ইউটান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই এলাকার রাস্তার উন্নয়নের কাজে ব্যবহারের জন্য আরও অনেকগুলো বাসের সাথে এনেছিল। উদ্দেশ্য, শ্রমিকদের অস্থায়ী আবাস তৈরী। কাজ শেষে বাকি সকল বাস ফিরিয়ে নেয়া হলেও ১৪২ নাম্বার বাসটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ফেলে যাওয়া হয়। তারপর থেকে এটি শিকারি আর পথিকের বিশ্রাম বা সাময়িক আবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৪২ নাম্বার বাসের নাম ম্যাজিক বাস দিয়েছিল ক্রিস্টোফার ম্যাকেন্ডলেস

ক্রিস্টোফার ম্যাকেন্ডলেস আর কেউ নয়। ১৯৯২ এর সেপ্টেম্বরে পাওয়া লাশটি তারই। মাত্র দুই বছর আগেই সে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে। তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে সকল বন্ধন ছিন্ন করে অনির্দেশ পথে যাত্রা করে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সকল পথ বন্ধ করার জন্য সে তার শিক্ষা সনদ আর অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে দেয়, জমানো সম্পদ দান করে দেয় চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানে। এমনকি এক সময় নিজের ক্যাশ টাকাও পুড়িয়ে ফেলে। তারপর একদিন আশ্রয় নেয় ম্যাজিক বাসে। দিন কয়েক পরে খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় ফিরতে চায় জনপদে কিন্তু খরস্রোতা হয়ে যাওয়া নদীর কারণে ফেরা সম্ভব হয় না। তারপর একদিন নীল রঙের ম্যাজিক বাসেই তার মৃত্যু হয়।

ক্রিস্টোফার কোন বিখ্যাত ব্যক্তি না, তার দেয়া নাম ‘ম্যাজিক বাস’ও তার মৃত্যুর পূর্বে কেউ জানতো না। তার লাশ উদ্ধারের কয়েক মাস বাদে ১৯৯৩ সালে জন ক্রাকাউর নামের একজন সাংবাদিক লাশের সাথে পাওয়া নোটবুক থেকে নেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে একটি প্রবন্ধ লিখেন, যার শিরোনাম ছিল ‘ডেথ অব অ্যান ইনোসেন্ট’। পরে ১৯৯৬ সালে তিনি একটি বই লিখেন যেখানে ক্রিস্টোফার সহ আরও কয়েক ব্যক্তির আখ্যান ছিল। ‘ইনটু দ্য ওয়াইল্ড’ শিরোনামের এই বইটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সারা বিশ্বে ত্রিশের অধিক ভাষায় অনূদিত হয়। বইয়ের সাথে সাথে বিখ্যাত হয়ে উঠে ক্রিস্টোফার ম্যাকেন্ডলেস এবং ম্যাজিক বাস।

আরও প্রায় এক যুগ পরে ১৯৯৭ সালে শন পেন পরিচালিত ‘ইনটু দ্য ওয়াইল্ড‘ সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় ক্রিস্টোফার এবং তার ‘ম্যাজিক বাস’ এর পরিচিতি আরও বহুগুণে ছড়িয়ে পড়ে। জন ক্রাকাউরের বইয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এই সিনেমায় ১৯৯০ সালে ক্রিস্টোফার ম্যাকেন্ডলেস এর গ্রাজুয়েশন থেকে শুরু করে ম্যাজিক বাসে মৃত্যুবরণ পর্যন্ত সময়কে ধারণ করা হয়েছে। শন পেনের দক্ষ নির্মাণ ক্রিস্টোফার ম্যাকেন্ডলেসকে দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে সাহায্য করে। সিনেমাটি দুটি অস্কার এবং দুটি গোল্ডেন গ্লোবের জন্য মনোনীত হয়েছিল।

বই এবং সিনেমার জনপ্রিয়তা স্ট্যাম্পেড ট্রেইল এবং ম্যাজিক বাসকে হিচ-হাইকার এবং দুঃসাহসী ভ্রমণপিপাসুদের গন্তব্যস্থল করে তোলে। বহু বছর ধরেই ট্রেকাররা ম্যাজিক বাস দেখতে আসছেন এবং তাদের অনেকেই নানা রকম বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। ক্রিস্টোফার ম্যাকেন্ডলেস যে নদীর কারণে সভ্য জগতে ফিরে যেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেই নদীতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন কেউ কেউ।

ক্রিস্টোফার ম্যাকেন্ডলেস খুব প্রভাবশালী কেউ ছিলেন না। গ্রাজুয়েশন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ে তার স্বাধীন, বিচিত্রমুখী এবং কষ্টকর অভিজ্ঞতা তাকে জীবন সম্পর্কে কিছু উপলব্ধি তৈরীতে সাহায্য করে যার কিছু কিছু সে তার নোটবুকে লিখে গিয়েছিল। ইনটু দ্য ওয়াইল্ড নামের বই ও সিনেমা তার কিছু তুলে ধরেছে বটে, কিন্তু মানুষকে মোহাবিষ্ট করেছে অনেক বেশী। একটি রোমান্টিক চরিত্র হয়ে উঠেছে ক্রিস্টোফার, রঙ্গীন স্বপ্ন আর ভাবালুতায় ডুবে থাকা সারা বিশ্বের তরুণরা তার অনুসারী। তবে, আমরা যে ক্রিস্টোফার ম্যাকেন্ডলেসকে চিনি, তার কতটুকু বাস্তব আর কতটুকু জন ক্রাকাউরের সৃষ্টি তা নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। যেমনটি রয়েছে তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে। আলুর মত দেখতে ফলের বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন ক্রিস, জন ক্রাকাউরের এমন দাবীর স্বপক্ষে শক্ত প্রমাণ নেই। অন্যদিকে খাদ্যের অভাবেই মারা গেছে ক্রিস – এমন দাবীর পেছনে যুক্তি অনেক থাকলেও রোমান্টিক যুবকেরা প্রথমটিকেই বেশি গ্রহণ করতে আগ্রহী।

শেষ কথা হলো, ম্যাজিক বাসকে কেন্দ্র করে যে মিথ গড়ে উঠেছে সেখানে সম্প্রতি বাগড়া দিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। তারা ট্রেকার আর হিচ-হাইকারদের তীর্থস্থান ম্যাজিক বাসকে দীর্ঘ প্রায় ষাট বছর বাদে সরিয়ে নিয়েছে। ট্রেকার আর হিচ-হাইকারদেরকে অহেতুক বিপদ থেকে রক্ষার জন্যই এই উদ্যোগ। যেহেতু বাসটিতে কোন ইঞ্জিন ছিল না, তাই হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে নিয়ে গেছে আলাস্কা কর্তৃপক্ষ। কোথায় সেটা কেউ জানে না। ধারণা করা যায়, এবার হয়তো ক্রিস্টোফার ম্যাকেন্ডলেস মিথের গতি কিছুটা রুদ্ধ হবে। তবে উল্টোটা হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়।

দৈনিক দেশ রূপান্তর অনলাইনে প্রকাশিত

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

2 Comments on “আলাস্কার নীলরঙা ম্যাজিক বাস”

  1. অসাধারণ লেখনি ভাই, থামবেন না আবার দয়া করে।

Leave a Reply to উল্লাস Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *