দেবী নিশীথিনীর পুনর্পাঠঃ কিছু নোটস

দেবী নিশীথিনী
দেবী নিশীথিনী
মিসির আলি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর প্রথম দুই বই – দেবী নিশীথিনী। ছবি: ডেইলি স্টার

গল্পের যাদুকর হুমায়ূন আহমেদ এর তৈরি চরিত্রগুলোর মধ্যে একটিমাত্র চরিত্রের প্রতি আমি টান অনুভব করি, তিনি মিসির আলি। এর প্রধান কারণ সম্ভবত মিসির আলির রহস্য সমাধানে আগ্রহী মন। তিনি হুমায়ূন আহমেদের গোয়েন্দা, তবে তার কাজের ধরণ ভিন্ন। অতিপ্রাকৃত বিষয়ের সমাধান তিনি করেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর যুক্তির মাধ্যমে।

মিসির আলিকে হুমায়ূন আহমেদ প্রথম উপস্থাপন করেন দেবী উপন্যাসের মাধ্যমে, ১৯৮৫ সালে। দেবী বেশ সফলতা লাভ করেছিল, ফলে ১৯৮৬ সালে মুক্তি পায় মিসির আলিকে নিয়ে দ্বিতীয় উপন্যাস নিশীথিনী। কিছুদিন আগে দেবী অবলম্বনে জয়া আহসানের প্রযোজনায় এবং অনম বিশ্বাসের পরিচালনায় দেবী চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। মিসির আলি চরিত্রকে রূপ দিয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী, রানু চরিত্রকে জয়া। চলচ্চিত্র মুক্তির প্রথম দিন থেকেই অভিযোগ ছিল, দেবী মিসির আলিকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র নয়, এটি প্রযোজক জয়া আহসান অভিনীত চরিত্র রানুকে নিয়ে নির্মিত। নানা কারণেই এই চলচ্চিত্রটি আমার দেখা হয়ে উঠেনি। সম্প্রতি সিনেমা দেরীতে নামে লিখেন এমন একজন ব্লগারের দেবী চলচ্চিত্র ও উপন্যাসের বিশ্লেষণ ও সমালোচনা পড়তে গিয়ে দুটো উপন্যাসই পুনরায় পড়ার প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। দুইদিনে দুটো উপন্যাস পাঠ শেষে আমার এলোমেলো কিছু নোটস লিখলাম।

দেবী নিশীথিনী বিষয়ক নোটস

১। দেবী নিশীথিনী একত্রে পড়া উচিত। স্পষ্টতই নিশীথিনী, দেবীর সিক্যুয়েল। যদিও, নিশীথিনী স্বয়ংসম্পূর্ণ, দুটো বই একত্রে পড়া হলেই এদের গভীর সম্পর্ক অনুধাবন করা সম্ভব হবে। তবে বই দুইটি একত্রে লেখা হয়েছে বলে মনে হয়নি। এমনকি দেবী লিখার সময় নিশীথিনী লিখার চিন্তা ছিল বলেও মনে হয়নি। প্রথম বইয়ের সাফল্যে সিক্যুয়েল লিখা হয়েছে। বইয়ের শুরুতে প্রকাশকের বক্তব্যেও তাই স্পষ্ট হয়। প্রকাশক লিখেছেন,

দেবীর দ্বিতীয় পর্ব এই নিশীথিনী। আর দেবীর মতো এটিও একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস এবং আগে কোথাও প্রকাশিত হয় নি। দেবী প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের আগ্রহ ও অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রকাশিত হলো মিসির আলির আরেকটি রহস্য উন্মোচন-পর্ব।

২। দেবীতে দেবীই প্রটাগনিস্ট। মিসির আলি দেবীর একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দাঁড়া করানোর চেষ্টা করেছেন সেগুলো গ্রহণযোগ্য হলেও সত্য নয় যা রানু ও নিলুর ঘটনাবলীর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। দেবী যে যুক্তির বাহিরের কিছু সেটা মিসির আলি বিশ্বাস করতে না পারলেও আমরা পাঠকেরা বিশ্বাস করেছি। তবে এই বিশ্বাস করতে গিয়ে মিসির আলির প্রতি বিরক্ত হইনি।

৩। দেবীতে এন্টাগনিস্ট হিসেবে আহমেদ সাবেতকে আনা হয়েছে। কিন্তু সাবেত শক্তিশালী এন্টাগনিস্ট নয়। বরং সাবেত দেবীর উপস্থিতির প্রমাণক। অবশ্য মিসির আলি সাবেতের পরিণতিরও একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটা দেবীতে নয়, নিশীথিনীতে। সেই ব্যাখ্যা যতটা না পাঠকের উদ্দেশ্যে তারচেয়ে বেশী মিসির আলির নিজের অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য।

৪। দেবী নিশীথিনীর মধ্যে নিশীথিনী শক্তিশালী এন্টাগনিস্ট পাওয়া যায়। সে হলো ফিরোজের মধ্যকার ছোট চৌধুরী। মিসির আলি হলেন প্রটাগনিস্ট এবং এন্টাগনিস্টের মাঝের চরিত্র। এন্টাগনিস্ট তাকে মারার চেষ্টা করছে, প্রটাগনিস্ট বাঁচানোর। ভালো শক্তি এবং খারাপ শক্তির মধ্যকার লড়াইয়ের সাক্ষী হলো পাঠক, মিসির আলি নয়।

৪। মিসির আলির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতির ঘটনা, দ্বন্দ্ব সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। এর সাথে গল্পের কোন সম্পর্ক পাওয়া গেল না। তাহলে কেন এই প্রসঙ্গের উপস্থাপন? আমার ধারণা, লেখক হুমায়ূন আহমেদের জীবনে এরকম কোন ঘটনা ঘটেছিল। তিনি তার নিশীথিনী উপন্যাসের মাধ্যমে এই ঘটনাটি উপস্থাপন করে প্রতিশোধ নিয়েছেন।

৫। দেবী নিশীথিনী – দুই জায়গাতেই মিসির আলি ব্যর্থ। তিনি নানাভাবে ব্যাখ্যাতীত বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে গেলেও না সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন তার সামনে উপস্থিত চরিত্রগুলোকে, না পাঠককে। তার অসাধারণ জ্ঞান এবং সূক্ষ্ম চিন্তাশক্তি সম্পর্কে বারবার বলা হয়েছে, চিন্তাশক্তির পরিচয় দেয়া হয়েছে, জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু এ সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে তার একগুঁয়েমী।

৬। বরং মিসির আলির মানবিক কিছু বৈশিষ্ট্য বেশ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। নিশীথিনীতে হানিফা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে। কিন্তু হানিফা চরিত্রটিকে কেন আনা হয়েছে? নিলু হানিফা সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছে, যার মাধ্যমে নিলুর ক্ষমতার পরিচয় মিসির আলিকে দেয়া হয়েছে তা তো অন্য যে কোন ঘটনার মাধ্যমেও দেয়া যেতো। ইনফ্যাক্ট, নিলুর এই ক্ষমতা প্রয়োগের কোন ব্যাখ্যা কিন্তু মিসির আলি দেন নি।

৭। দেবী নিশীথিনীকে নিয়ে কোন একাডেমিক আলোচনা কখনও হয়েছিল কিনা জানি না। কিংবা হুমায়ূন আহমেদ কখনও কোন সাক্ষাৎকারে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন কিনা। যদি করে থাকেন সেক্ষেত্রে কিছু বিষয় পরিষ্কার হতো। দেবী নিশীথিনী নিয়ে আরও কিছু পড়ার সুযোগ পেলে ভালো লাগবে।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ মিসির আলিকে নিয়ে প্রথম আলোতে কে এই মিসির আলি শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়েছিল, পড়ে দেখতে পারেন।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

One Comment on “দেবী নিশীথিনীর পুনর্পাঠঃ কিছু নোটস”

  1. উপন্যাস দুটো আবার পড়তে হবে। ভাল লেখা।

Leave a Reply to সাকিব শাহরিয়ার Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *