ভালোবাসা আজকাল: কুমিরের পিঠ খাজকাটা

ফাঁকিবাজ ছাত্র আর কুমিরের খাজকাটা পিঠ – গল্পটা জানেন? পরীক্ষায় যে বিষয়েই রচনা লিখতে বলা হোক না কেন – পিতা মাতার কর্তব্য, আমার প্রিয় শিক্ষক অথবা পলাশীর যুদ্ধ – ছাত্র ঘুরে ফিরে শেষ পর্যন্ত সেই খাজকাটা পিঠের অধিকারী কুমিরের রচনা লিখে দেয়। ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটি চলচ্চিত্রের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশী সফল পি এ কাজল পরিচালিত এবং শাকিব খানমাহি জুটির প্রথম চলচ্চিত্র ‘ভালোবাসা আজকাল’ একটি বিনোদনমূলক ‘কুমিরের পিঠ খাজকাটা’ চলচ্চিত্র।

ভালোবাসা আজকাল চলচ্চিত্রের কোন নির্দিষ্ট কাহিনীকার নেই – কাহিনী তৈরী করেছেন ‘ভালোবাসা আজকাল’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক পরিবেশক প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া। হলিউডের মত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকেও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক করে তোলার চেষ্টায় জাজ মাল্টিমিডিয়া ইতোমধ্যেই সফল – জাজের ছবি মানে একটু ভিন্ন কিছু – এমন ধারনা তৈরী হয়েছে অনেক দর্শকের মাঝে। ফলে, কাহিনী সংক্রান্ত সকল প্রশংসা-নিন্দা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার উপরই বর্তায়, প্রতিষ্ঠানটিও যে জেনেশুনে এই ঝুঁকি গ্রহণ করেছে সেটাও স্পষ্ট হয়ে উঠে টাইটেলে কাহিনীকার হিসেবে ‘জাজ’ এর নাম ভেসে উঠলে।

নানা উপায়ে লোক ঠকালেও আবুলের (কাবিলা) প্রধান পেশা হল বিয়ের আয়োজন করে লোক ঠকানো এবং চুরি। প্রধান সহযোগী প্রতারণা করতে গিয়ে ধরা পড়লে আবুল তার ভাগ্নে রানাকে (শাকিব খান) দলে ঢুকিয়ে নেয়। যে উপায়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে রানা প্রতারণার কার্যক্রমে, মামা আবুলের ভাষায় ‘আঙ্গুল বাঁকা করা’, অংশগ্রহণ শুরু করে, তাতে আশা ও হতাশা দুই-ই বৃদ্ধি পায়। দেশের সব মানুষ, বিশেষ করে চলচ্চিত্র জগতের নির্মাতারা যদি এভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতেন, তবে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য ভারতকে মানববন্ধন-সভা-আলোচনা করতে হত।

মামা-ভাগ্নে জুটিবদ্ধ হওয়ার পরই ‘মামু-ভাইগ্না গুড লাক’ গান শুরু হয়। শ্রুতিমধুর গানের মিউজিকের ছন্দে সম্পাদনা চমৎকার, গানের দৃশ্যায়নও আকর্ষণীয়, লিরিক গ্রহনযোগ্য। গানের মাধ্যমে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই পদ্ধতিটি দারুন কার্যকর। গানের চিত্রায়নে আরেকটি নতুনত্ব পাওয়া যায় ‘এই প্রথম একটি মুখ’ এর দৃশ্যায়নে। প্রায় পুরো গানটিই গ্রীন-ক্রোমার মাধ্যমে করা হয়েছে। কিছু কিছু দৃশ্যে বেশ ভালোভাবে খাপ খেয়ে গেলেও অনেকগুলোতেই ব্যাকগ্রাউন্ড আর ফোরগ্রাউন্ডের অনুপাতের ফারাক স্পষ্ট। এ উদ্যোগ ভালো ও প্রশংসনীয়। পিরিয়ড সিনেমা নির্মানে প্রযুক্তির এই ব্যবহার আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে।

বড় আকারের দান মারার আশায় প্রতারক আবুল ধনী পরিবারের বিদেশ ফেরত মেয়ের সাথে রানার বিয়ের চেষ্টা চালায়। ঘটনাচক্রে এই প্রতারক জুটির পরিবারে ঢুকে পড়ে বিদেশে বড় হওয়া এবং বাবার কাছ থেকে পালিয়ে আসা মেয়ে ডানা (মাহি)। ডানাকে খুজে বের করার জন্য তার বাবা (আলীরাজ) লোকজন নিয়োগ করে এবং বড় অংকের পুরস্কার ঘোষনা করে, অথচ ডানা বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার আগেই বান্দরবানের একটি নির্দিষ্ট বাড়ি খুজে বের করতে আগ্রহী। প্রতারক দল থেকে উদ্ধার পাওয়া, বাবার লোকদের এবং পুরস্কারের লোভে ছুটে আসা লোকদের চোখ এড়িয়ে বাড়িটি খুজে বের করা ইত্যাদি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে ভালোবাসা আজকাল ছবির গল্প এগিয়ে যায়।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই গল্পে থাকতে পারে নি জাজ এবং পি এ কাজল – গত দেড় দুই যুগ ধরে প্রচলিত খাজকাটা কুমিরের গল্পেই ঢুকে পড়েন তারা। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বান্দরবানের পাহাড়ি লতাপাতা দিয়ে হিমোফিলিয়া (অনুচক্রিকার অভাবে রক্ত জমাট বাধে না যে রোগে) নামক দুরারোগ্য রোগ সারিয়ে ফেলে কবিরাজ বাবার ছেলে রানা, একই দাওয়াইয়ে পেটে ছুড়ির আঘাত নিয়েও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে সে – দুর্দান্ত অ্যাকশনে একে একে তেরোজন লোককে জখম করে আহত শরীরেই। জাজ হয়তো একটি দারুন টুইস্টিং সমাপ্তি টানার চেষ্টা করেছিল, এবং সে উদ্দেশ্যে পুলিশ অফিসারের (মিশা সওদাগর) সংলাপে সামান্য ইঙ্গিতও দিয়েছিল, ফলে্ একটি ক্লান্তিকর, অবাস্তব এবং অপ্রাসঙ্গিক সমাপ্তির দিকে টেনে নিয়ে গেছে গল্পকে।

ছবির শেষের এই এক চতুর্থাংশকে বাদ দিলে ‘ভালোবাসা আজকাল’ একটি সফল বিনোদনমূলক ছবি, এবং, এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অভিনেতা কাবিলার। জাজের প্রথম ছবি ‘ভালোবাসার রঙ’-এর রিভিউতে কাবিলা নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মানের পরামর্শ দিয়েছিলাম, ‘ভালোবাসা আজকাল’ দেখার পর মনে হচ্ছে সেই পরামর্শ মেনে শাকিব খানকে দর্শক টানার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

শাকিব খান সাম্প্রতিক সময়ের ছবিগুলোর তুলনায় অনেক ভালো অভিনয় করেছেন, তার কানের দুলগুলো দূর হলেও পকেটে হাত দিয়ে অভিনয় করার অভ্যাস দূর হয় নি। বয়স নাকি ভারী শরীর জানি না, তার দৌড়ানোর প্রতিটি দৃশ্যই দৃষ্টিকটু। ছবির নায়িকা মাহি শ্রাবণের আবহাওয়ার মত অভিনয় করেছেন – এই ঝলমলে রোদ তো এই অতি অভিনয়ের কাদা-বৃষ্টিতে মাখামাখি। পোড়ামন ছবিতে সে তুলনায় বেশ পরিণত অভিনয় করেছিল মাহি। অবশ্য নতুন নায়িকা মাহির কাছ থেকে ফাল্গুনের অভিনয় পেতে হলে আষাঢ়-শ্রাবণের দুর্যোগ পার করতে হবে এবং এজন্য যোগ্য পরিচালনার প্রয়োজন খুব বেশী।

শাকিব খান – মাহির কস্টিউম এবং জেলখানা ও পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ির সেটের জন্য সিনথিয়া এবং কলমতরকে একটু নিন্দে করতেই হয়। মাহির কস্টিউমের ক্ষেত্রে পরিচালকের-কস্টিউম ডিজাইনারের ‘আঙ্গুল বাকানো’ মনোভাব আর জেলখানার সেট তৈরীর পেছনে ‘ম্যায় হু না’ চলচ্চিত্রে ফারাহ খানের ‘ক্লাসরুমের সেট’ আইডিয়া কাজ করেছে বলে ধারনা করছি – সতর্ক দৃষ্টি প্রয়োজন এ দুক্ষেত্রেই।

ভালোবাসা আজকাল ছবির বড় সাফল্য – এখন পর্যন্ত এর গল্প-গান মৌলিক হিসেবে প্রমাণিত – এই ধারা অব্যাহত থাকলে, কাহিনীকার কোন ব্যক্তি না প্রতিষ্ঠান – সে প্রশ্ন গুরুত্ব পাবে না। প্রত্যেকটা ছবির মুক্তিতে আমরা দর্শকরা অনেক আশা নিয়ে সিনেমাহলে যাই, অস্বাচ্ছন্দকর পরিবেশে ঘামতে ঘামতে ছবি দেখি, ধারনা করতে থাকি – এই ছবিটা আর দশটা ছবির মত হবে না, হল থেকে বের হয়ে হাসিমুখে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো – আর পাঁচটা বছর যদি ভারতীয় সিনেমাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়, তাহলে আমরাই প্রকাশ্যে বাংলাদেশের বাজার খুলে দেবো ভারতীয় ছবির জন্য, দেখবো প্রতিযোগিতায় তারা টিকে থাকতে পারে কিনা – কিন্তু ধারনা সত্যি হয় না – গল্পের খাজকাটা পিঠের কুমীর আমাদের স্বপ্নকে কামড়ে ধরে, টিকে থাকাই তখন বড় হয়ে দাড়ায়।

মাননীয় প্রযোজক-পরিচালক – আপনাদের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি, খাজকাটা পিঠের কুমির থেকে আমাদের মুক্তি দিন!

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

4 Comments on “ভালোবাসা আজকাল: কুমিরের পিঠ খাজকাটা”

  1. বরাবরের মতই সুন্দর রিভিউ। ছবিটা দেখার কথার থাকলেও দেখা হলোনা। :/
    নি:স্বার্থ ভালোবাসা দেখলাম। ছবিতে কাবিলাকে খুবই বিরক্ত লেগেছে। এই ছবিতে মিশা সওদাগরকে আবার বেশ ভালো লেগেছে।
    ইয়ে বস গ্রীন-ক্রোমার কী জিনিস??

    1. গ্রীন ক্রোমা (Green Chroma)। ছবি শ্যুট করার সময় যে অংশ প্রয়োজন, পুরো সেট, পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড বা ফোরগ্রাউন্ডের নির্দিষ্ট অংশ ইত্যাদি সবুজ রং এর কিছু দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়, লাইক সবুজ কাপড়। পরে এডিটিং প্যানেলে নিয়ে ওই সবুজ রং এর জায়গায় যা খুশি বসিয়ে নেয়া যায়। ধরা যাক, আপনার ব্যাকগ্রাউন্ডে সবুজ কাপড়ে ঢেকে আপনাকে বলা হল দৌড়ে সামনে ক্যামেরার দিকে আসতে। তারপর এডিটিং প্যানেলে নিয়ে সবুজ কাপড়ের জায়গায় বসিয়ে দেয়া হল একটি বাঘ দৌড়ে আসছে ক্যামেরার দিকে – দুটো মিলে যে দৃশ্যটা তৈরী হবে সেটায় দেখা যাবে আপনাকে বাঘ দৌড়ানি দিছে আর আপনি পালাচ্ছেন।
      ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখে নিন – পুরোটা বুঝে যাবেন।

  2. ছবি দেখেছি। তবে বিরতির পর ১০ মিনিট পর্যন্ত। এ সময় পর্যন্ত খারাপ লাগেনি। রিভিউ পড়ে ভাল লাগলো এটা ভেবে যে, বিরতি শেষে ছবির গতি কমার যন্ত্রণা থেকে বেঁচে গিয়েছি।
    যা হোক, রানা চরিত্রে শাকিব খানকে বেমানান লেগেছে। মাহির সঙ্গেও শাকিবকে বেমানান ঠেকেছে। শরীরের চর্বি না কমালে শুধু অভিনয় গুণে শাকিব আর বেশি দিন ঠিকবেন বলে মনে হয় না। আপনি কি আমার সঙ্গে এক মত?
    ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা!!!

Leave a Reply to দারাশিকো Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *