বলিউডের মাসালা সিনেমা

বলিউডে এখন রেকর্ডের রমরমা অবস্থা। কুকুর মাথার ছবি সম্বলিত সেই গোল কালো রং এর চাকতি বা রেকর্ড তার দিন হারিয়েছে আগেই, এখন রেকর্ড হয় সব কিছুকে ছাপিয়ে ওঠায়। বলিউড সিনেমার বাজারে এখন প্রতিদিনই রেকর্ড হচ্ছে এবং এই রেকর্ড তৈরীর পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে বলিউডের মাসালা সিনেমাগুলো।

গত একমাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই শাহরুখ খান অভিনীত ‘রা ওয়ান’ সিনেমার খবর প্রকাশিত হচ্ছে দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক পত্রিকায়, লক্ষ লক্ষবার শেয়ার হচ্ছে ফেসবুকে, টুইটারে। সবার মুখে এক কথা রা ওয়ান। মুক্তি পাবার পর থেকেই রেকর্ডের ছড়াছড়ি – বডিগার্ডের রেকর্ড ভেঙ্গে সবচে বেশী সিনেমাহলে মুক্তি পেয়েছে রা ওয়ান, সবচে বেশী অর্থ তুলে নিয়েছে প্রথম সপ্তাহেই ইত্যাদি ইত্যাদি। রা ওয়ান একটি সুপারহিরো অ্যাকশন সিনেমা এবং ২০১১ সালটি যেন অ্যাকশন সিনেমারই বছর। ডিপার্টমেন্ট, পাওয়ার, এজেন্ট বিনোদ, বডিগার্ড, কিক, সিংহাম, প্লেয়ারস, টেজ ইত্যাদির তালিকায় সর্বশেষ সংযুক্তি রা ওয়ান।

বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়

সিনেমার বিভিন্ন ধারার মধ্যে অ্যাকশন সিনেমা একটি। সিনেমার এক বা একাধিক চরিত্র যখন সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাড়ায়, শারীরিক এবং সামরিক, কখনো কখনো প্রযুক্তি, শক্তির ব্যবহারে একে একে ঘায়েল করে সমাজের বিষফোড়া ভিলেনকে, সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনে এমন সিনেমাই অ্যাকশন সিনেমা হিসেবে পরিচিত। অ্যাকশন সিনেমাগুলোয় নায়ক বা তার সহযোগিরা সবসময়ই ভালোর প্রতিনিধিত্ব করবে তা নয়, খারাপের প্রতিনিধিত্ব করলেও অধিকতর খারাপের উপর বিজয়ী হওয়ায় তাকে ভালোরই প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা যায়।

হলিউডে গত শতকের ২০-৩০ দশকে অ্যাডভেঞ্চার এবং থ্রিলার সিনেমাগুলো যাত্রা শুরু করার অনুষঙ্গ হিসেবে অ্যাকশন দৃশ্যের যাত্রা শুরু হলেও ৭০ এর দশকে এসে অ্যাকশন সিনেমা একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একক পুলিশ অফিসার কোন এক ঘটনায় বিশাল এক গ্যাংস্টারকে তার দলসহ দমন করার মাধ্যমে অ্যাকশন সিনেমার যাত্রা শুরু হয়, অবশ্য পরবর্তীতে এই পুলিশ অফিসারের জায়গায় নির্যাতিত সাধারণ জনগনও জায়গা করে নেয়। তবে বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে পুলিশ অফিসারদের সাথে তাদের পার্থক্য সামান্যই – এই সাধারণ জনগনও পেশী এবং অস্ত্রশক্তিতে বলিয়ান হয়ে বিজয়ী হয় প্রতিপক্ষের উপর। সিলভেস্টার স্ট্যালোন, ব্রুস উইলিস, আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার, স্টিভেন সিগাল, জ্যা ক্লদ ভ্যান ড্যাম, জ্যাকি চান এই ধারার সিনেমার প্রথম প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত।

বলিউডের মাসালা সিনেমা: শেকড়ের সন্ধানে

হলিউডের অ্যাকশন সিনেমার সাথে বলিউডের অ্যাকশন সিনেমার মূলগত কোন পার্থক্য না থাকলেও সিনেমাগুলোকে অ্যাকশন সিনেমার চেয়ে বলিউডের মাসালা সিনেমা হিসেবেই বেশী পরিচিতি দেয়। হিন্দী ‘মাসালা’ শব্দ দিয়ে বাংলার মশলা শব্দকে বোঝানো হয় যা রন্ধনকার্যে খাদ্যদ্রব্যকে সুস্বাদু করায় বেশী ভূমিকা পালন করে। একটি সিনেমাতেই দাঙ্গা-হাঙ্গামা, প্রেম-ভালোবাসা, নীতি-নৈতিকতা, সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক-ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং দু একটা আইটেম নাম্বার – সব কিছুর একমুঠো পরিমান সংমিশ্রন এর ‘মাসালা’ নামকরনের স্বার্থকতাকেই ইঙ্গিত করে। হলিউডের অ্যাকশন সিনেমার টার্গেটকৃত দর্শক সাধারণত একটি নির্দিষ্ট শ্রেনী হলেও বলিউডের মাসালা সিনেমার টার্গেট দর্শক আমজনতা।

হলিউডে সত্তরের দশকে অ্যাকশন সিনেমা নতুন ধারা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বলিউডের মাসালা সিনেমা বা অ্যাকশন সিনেমার আত্মপ্রকাশ তখনই। কিন্তু ভ্যালেন্তিনা ভিতালি নামে পূর্ব লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত গবেষনা গ্রন্থ “হিন্দী অ্যাকশন সিনেমা: ইন্ডাস্ট্রিজ, ন্যারেটিভস, বডিস” এ দাবী করেছেন হিন্দী অ্যাকশন সিনেমার শুরু সেই ‘৩০ এর দশকে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান কালের মাসালা সিনেমার অন্যতম উপাদান ফাইটিং-অ্যাকশন দৃশ্যগুলো সেই সময়ের বেশ কিছু সিনেমায় উপস্থিতি তাকে এ সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করেছে। সে হিসেবে দারা সিং, দিলিপ কুমার প্রভৃতিও অ্যাকশন হিরো হিসেবে গন্য হতে পারে।

১৯৬০ দশকের শেষ দিকে এসে বলিউডে অ্যাকশন সিনেমার প্রসার বৃদ্ধি পায়। এসময়ের অ্যাকশন হিরোদের মধ্যে রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র, সঞ্জিব কুমার এবং শশী কাপুর অন্যতম। মূলত হিন্দী রোমান্টিক সিনেমার পাশাপাশি বিভিন্ন অ্যাকশন দৃশ্যের কারণে এই সিনেমাগুলো অ্যাকশন রোমান্টিক সিনেমার উপাধিতে ভূষিত হয়। প্রেমিকাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে নায়ক সুপারহিরোর ভূমিকায় অবর্তীন হয় এবং একাই সকল মন্দলোককে পরাভূত করে তারপর নায়িকাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে – এমন কাহিনী নিয়েই সেই সময়ের বলিউডের মাসালা সিনেমাগুলো নির্মিত। ‘৭০র দশকের প্রারম্ভে আরও কিছু অ্যাকশন সিনেমা মুক্তি পায়, তবে সেগুলো খুব শক্তিশালী না হওয়ায় কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

ষাটের দশকে রোমান্টিক হিরো হিসেবে অভিনয় শুরু করা ধর্মেন্দ্র পরবর্তীতে পরিচিতি লাভ করে অ্যাকশন কিং হিসেবে। ৮০-র দশকের শেষ পর্যন্ত বেশ অনেকগুলো বিখ্যাত অ্যাকশন সিনেমার হিরো ধর্মেন্দ্র। রাজনৈতিক-সামাজিক শত্রুর বিরুদ্ধে কখনো সৎ পুলিশ অফিসার, কখনোবা খেটে খাওয়া প্রতিবাদী যুবক ইত্যাদি চরিত্রে অভিনয় করে অ্যাকশন হিরো হিসেবে নিজেকে পাকাপোক্ত করে নেন ধর্মেন্দ্র। তার অ্যাকশন সিনেমাগুলোর মধ্যে লালকার, প্রতিজ্ঞা, চরস, আজাদ, ভগবত, ধরম আউর কানুন, হুকুমাত, ওয়াতান কি রাখায়েল, আগ হি আগ, গোলামী, হাতিয়ার, লোহা ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

বলিউডের মাসালা সিনেমা সোলে

৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বলিউডে এক রাগী যুবকের উপস্থিতি সবার মনযোগ কেড়ে নেয়। এই রাগী যুবক একাই ভিলেনের বাহিনীর বিরুদ্ধে খালি হাতে কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে লড়াই করে, তাদেরকে কুপোকাত করে, বন্দী করে কিংবা নিজ হাতে কঠোর শাস্তি দেয়। ‘জাঞ্জির’  সিনেমার মাধ্যমে রাগী যুবকের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে তার প্রথম পদচারণা বাঙ্গালী সিনেমা নির্মাতা মৃণাল সেনের হিন্দী চলচ্চিত্র ‘ভুবন সোম’ এর কন্ঠদাতা হিসেবে। অবশ্য জাঞ্জির সিনেমার আগেই আরও বেশ কিছু সিনেমায় এই রাগী যুবক অভিনয় করেছেন, সেগুলো রোমান্টিক সিনেমা ছিল। এই রাগী যুবকের নাম অমিতাভ বচ্চন।

জাঞ্জিরের পরে অভিমান, নেমক হারাম, দোস্ত, মাজবুর, ফেরার ইত্যাদি সিনেমায় অ্যাকশন অভিনয়ের পাশাপাশি কিছু রোমান্টিক সিনেমায়ও অভিনয় করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালটা বলিউড সিনেমার ইতিহাসে স্মরনীয় করে রাখতে সাহায্য করেন অমিতাভ বচ্চন। এ সময় তার দুটো সিনেমা মুক্তি পায় – একটি দেওয়ার যেখানে যশ চোপড়ার পরিচালনায় অমিতাভ ছাড়াও শশী কাপুর অভিনয় করেছিল। একই বছর মুক্তি পায় ‘শোলে’ সিনেমাটি। এই সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের সাথে অ্যাকশন কিং ধর্মেন্দ্র অভিনয় করেছিল – এবং দুটো চরিত্রই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। প্রথম দিকে সিনেমাটি আশানুরূপ ব্যবসা না করলেও মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেরা ব্যবসাসফল সিনেমার জায়গা দখল করে নেয়।

আজও বলিউডের মাসালা সিনেমা কিংবা ভারতীয় অ্যাকশন সিনেমার নাম আসলেই শোলে’র নাম আসবেই, বিভিন্ন টপ মাস্ট সি মুভির তালিকায় দেওয়ার এবং শোলে’র নাম থাকবেই। পরবর্তীতে অমিতাভ বচ্চন ডন, শান, নাসিব, কালিয়া, দেশপ্রেম, দোস্তানা প্রভৃতি অ্যাকশন সিনেমায় অভিনয় করে আলোচিত হন। আজও অ্যাকশন সিনেমার গুরু হিসেবে অমিতাভ বচ্চন জায়গা দখল করে আছেন।

বলিউডের মাসালা সিনেমা সোলের দৃশ্য

৮০-র দশকের শেষ পর্যন্ত অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র প্রায় একক রাজত্ব করলেও এ সময় আরও কিছু অ্যাকশন অভিনেতা স্থান করে নেয়। এদের মধ্যে সানি দেওল, সঞ্জয় দত্ত, অনিল কাপুর, অজয় দেবগন, জ্যাকিশ্রফ, সুনীল শেঠি, অক্ষয় কুমার অন্যতম। অবশ্য এই সময়ে সালমান খান, শাহরুখ খান, আমির খান, সাইফ আলী খান প্রভৃতি তাদের অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু করলেও তাদের পরিচিতি অ্যাকশন সিনেমার নায়ক হিসেবে নয় বরং রোমান্টিক নায়ক হিসেবে বেশী ছিল। তবে এসকল অভিনেতাও সে সময় বেশ কিছু অ্যাকশন সিনেমায় অভিনয় করেছিল।

এ সময়ে অ্যাকশন দৃশ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্যনীয় বিশেষত: সিনেমার অ্যাকশন হিরোরা মার্শাল আর্ট, কারাতে প্রভৃতি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লড়াই করতো ভিলেন বাহিনীর সাথে। এই সময়ের সেরা অ্যাকশন সিনেমাগুলোর মধ্যে সানি দেওল অভিনীত বেতাব, অর্জূন, ইয়াতিম, ঘায়েল, ঘাতক, জিদ্দি, বর্ডার, অর্জূন পন্ডিত ইত্যাদি, সঞ্জয় দত্তের বাস্তব, খলনায়ক, কার্তূজ, হাতিয়ার, ক্রোধ, সাদাক ইত্যাদি, অজয় দেবগনের ফুল আউর কাটে, বিজয় পথ, জিগার, দিলজ্বলে, জং ইত্যাদি অন্যতম। অনিল কাপুরের জানবাজ, তেজাব, আন্দাজ, গুরুদেব ইত্যাদি অন্যতম।

১৯৯০ এর দশকে অক্ষয় কুমারের আগমনে বলিউডেরমাসালা সিনেমা এক অন্যরকম গতি লাভ করে। মার্শাল আর্ট এবং কারাতে নির্ভর সিনেমার হিরো হিসেবে অক্ষয় কুমার বেশ দ্রুতই তার অবস্থান তৈরী করে নেন। পাচটি সিনেমা নিয়ে তার খিলাড়ি সিরিজ সম্ভবত বলিউডের একমাত্র সিরিজ সিনেমা যেখানে এতগুলো পর্ব রয়েছে। খিলাড়ি সিরিজের খিলাড়ি, সবসে বড়া খিলাড়ি, খিলাড়িও কা খিলাড়ি, ইন্টারন্যাশনাল খিলাড়ি এবং খিলাড়ি ৪২০ ছাড়াও তার অন্যান্যা অ্যাকশন সিনেমাগুলোর মধ্যে মহড়া, জানোয়ার ইত্যাদি। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাকশন হিরো নন, বরং রোমান্টিক এবং কমেডিয়ান হিসেবে অক্ষয় বেশী পরিচিত।

বলিউডের অ্যাকশন সিনেমা তার গতিপথ আবারও পরিবর্তন করে ২০০০ এর দশকে। এ সময় বেশ কিছু আন্ডারওয়ার্ল্ড কার্যক্রম নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়। এর আগের দশকগুলোতে যেমন অ্যাকশন হিরো হিসেবে কিছু অভিনেতার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, এসময় তা পাওয়া যায় না বরং পুরোনো অভিনেতারাই চালিয়ে যাচ্ছেন। মাফিয়া কার্যক্রম নিয়ে সিনেমার মধ্যে কোম্পানি, খাকি, কাটে, ধুম, কেয়ামত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

অ্যাকশন সিনেমার বর্তমান

বলিউডের মাসালা সিনেমা দাবাং

গত কয়েক বছরে বলিউডের মাসালা সিনেমার অনেক উন্নতি হয়েছে। রোমান্টিক সিনেমার হিরোরা অ্যাকশন সিনেমায় অভিনয় করছেন কম বেশী, ভালো করছেন। রোমান্টিক হিরো হিসেবে পরিচিত সালমান খান এবং শাহরুখ খান একসময় সফল অ্যাকশন সিনেমা করন-অর্জুনে অভিনয় করে দীর্ঘদিন অ্যাকশন হিরো হিসেব অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে এরা দুজনেই অ্যাকশন ধারার সিনেমার দিকে ঝুকেছেন্ এমনকি সবসময়ের রোমান্টিক এবং ভিন্ন ধারার অভিনেতা আমির খানও গজিনীর মতো অ্যাকশন সিনেমায় অভিনয় করেছেন। অ্যাকশন সিনেমার তালিকায় সালমান খান এখন এক নম্বরে। তার ওয়ান্টেড, দাবাং এবং বডিগার্ড তাকে অ্যাকশন হিরো হিসেবে নতুন করে পরিচয় করে দিয়েছে। বলিউডের মাসালা সিনেমার পাশাপাশি রয়েছে সুপারহিরো সিনেমা। গজিনি, রা ওয়ান – এ ধারারই নতুন সংযোজন।

সিংহাম বলিউডের মাসালা সিনেমা

গত দু’বছর ধরে নতুন যে বিষয়টি লক্ষ্যনীয় তা হলো অ্যাকশন সিনেমার রিমেক। যদিও বলিউড ভারতীয় সিনেমাকে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে ভালো সিনেমা নির্মিত হচ্ছে এবং তামিল সিনেমা এদিক থেকে বেশ এগিয়ে। বিশেষ করে অ্যাকশন সিনেমার পথিকৃত হিসেবে তামিল সিনেমার নামই বলতে হয়। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে নান্দনিকতা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার তামিল অ্যাকশন সিনেমাগুলোকে অন্যরকম জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে ব্যবসাসফল তামিল সিনেমাগুলোর রিমেক হচ্ছে বলিউডে। গজিনি, বডিগার্ড, ওয়ান্টেড, সিংহাম, কিক – এ সবই তামিল সিনেমার রিমেক।

অ্যাকশন সিনেমার প্রযুক্তি

শুরুর দিকের অ্যাকশন সিনেমার প্রযুক্তির তুলনায় বর্তমান সময়ের প্রযুক্তির ব্যবহার আকাশ পাতাল ফারাক। ২০ বছর পূর্বের অ্যাকশন সিনেমায় স্টান্টম্যান দিয়ে ঝুকিপূর্ন দৃশ্যগুলো ধারন করা হলেও বর্তমানকালে এর পরিমান কমে গেছে। প্রযুক্তির ব্যবহারের কারনেই সিনেমার হিরোরাই এখন ঝুকি নিচ্ছেন অনেক বেশী। পূর্বের অ্যাকশন সিনেমায় নায়ক বা স্টান্টম্যানের দক্ষতার উপরে নির্ভর করতে হতো অনেক বেশী। ফলে মার্শাল আর্ট কারাতে জানা অভিনেতারাই অ্যাকশন সিনেমার দিকে আগ্রহী হয়েছেন।

বর্তমান সময়ে শ্যুটিং এর সময়ে অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে সুতার ব্যবহার এবং পরবর্তীতে সম্পাদনার টেবিলে তার যথাযোগ্য ব্যবহার বিশেষত ইফেক্টস এর ব্যবহার সিনেমাকে আরও দর্শনীয় এবং উপভোগ্য করে তুলেছে। অ্যাকশন দৃশ্যের দৃশ্যায়ন এবং পরিচালনার জন্য হলিউড থেকে বিশেষজ্ঞ লোকদের নিয়ে আসা হচ্ছে। এর প্রভাবে সিনেমায় বাজেটের পরিমানও বাড়ছে, ছবির প্রচারের জন্য সময়সীমা এবং বাজেটের পরিমান বেড়েছে নির্মানের সময়ের তুলনায়ও বেশী। এক রা ওয়ান সিনেমার জন্য শাহরুখ খান গত ছয়মাস ধরে সারা বিশ্বে প্রচারনা চালিয়েছেন। অ্যাকশন সিনেমার সাফল্যের জন্য হলিউডের অভিনেতারেও আমন্ত্রন জানানো হচ্ছে – আশা করা হচ্ছে, তাদের যোগদানে বলিউডের অ্যাকশন ধারাটি আরও বিস্তৃত হবে, সারা বিশ্বে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

বিশ্বমানের সিনেমা?

বলিউড অ্যাকশন ধারায় যে সিনেমা নির্মান করে যাচ্ছে তা যদিও ক্রমশই বিশ্ববাজারে প্রবেশ করছে এবং এর পরিধি বাড়িয়ে নিচ্ছে, কিন্তু কতটুকু বিশ্বমানের অ্যাকশন সিনেমা বলিউড নির্মান করছে সে নিয়ে বিতর্ক আছে। খোদ ভারতীয় সমালোচকরাই হিন্দী অ্যাকশন সিনেমার কাহিনী এবং এর স্টাইল নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, সমালোচনা করছে। বলিউডের অ্যাকশন সিনেমা বলতে যে সিনেমাগুলোকে ইঙ্গিত করছে তাকে খাঁটি অ্যাকশন সিনেমা হিসেবে চিহ্নিত না করে বলিউডের মাসালা সিনেমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এর উপাদানগুলোর জন্যই।

উন্নত বিশ্বের অ্যাকশন দৃশ্যের সাথে বলিউডের মাসালা সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্যের যথেষ্ট পার্থক্য। হিন্দী সিনেমায় নায়ককে সুপারহিরোর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় সকল অ্যাকশন দৃশ্যেই স্লো-মোশন এবং একাই দশ-বিশজনকে ঘায়েল করা, গুরুত্বভেদে ছোট থেকে শুরু করে সবচে বড় ভিলেনকে পর্যায়ক্রমে হত্যা করা, এবং যুদ্ধ শেষে গালে কিংবা হাতে ছুড়ির আঘাত নিয়ে হাসিমুখে সিনেমা শেষ করা কিংবা একটি অ্যাকশন দৃশ্যের সাথে সমান্তরাল একটি গান – বলিউডের মাসালা সিনেমাকে একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতেই আবদ্ধ করে রেখেছে। ফলাফল, যদিও ভারতের প্রেক্ষাগৃহগুলোর পাশাপাশি এশিয়া, ইউরোপের অনেকগুলো প্রেক্ষাগৃহে সিনেমার মুক্তি দেয়া হচ্ছে – দর্শক কিন্তু সেই ভারতীয়রাই।

এছাড়াও রয়েছে নকলপ্রবণতা। হলিউড থেকে শুরু করে কোরিয়ান, ফ্রেঞ্চ এবং স্প্যানিশ সিনেমা, কাহিনী, সংলাপ থেকে শুরু করে সিনেমার পোস্টার পর্যন্ত কপি-পেস্ট প্রবণতা ভারতীয় সিনেমাকে বৈশ্বিক দর্শকের কাছে কিছুতেই গ্রহনযোগ্য করে তুলতে পারে না। তামিল সিনেমার সাফল্যে রিমেক স্বত্ব কিনে নিয়ে যে হিন্দী সিনেমা নির্মান করা হয় দেখা যায় সেই তামিল সিনেমাটিই কোন না কোন হলিউড বা কোরিয়ান সিনেমার তামিল ভার্সন। ব্যবসা সাফল্যের দিকে চেষ্টা করা অবশ্যই জরূরী কিন্তু তাই বলে নকল করার প্রবণতাকে কাটিয়ে উঠতে না পারলে বলিউডের মাসালা সিনেমা কেবল ব্যবসা-ই করে যাবে, বৈশ্বিক মানের শিল্প কখনো তৈরী করতে পারবে না।

(এই লেখাটি ২০১১ এর অক্টোবরে লিখেছিলাম, নানা জটিলতার কারণে প্রকাশ করতে দেরী হয়ে গেল। আপডেট তথ্যাবলী না থাকার কারণে ক্ষমাপ্রার্থী। কিছু সম্পাদনাসহ এই লেখাটি সমকাল ঈদ উপহার ২০১২-তে প্রকাশিত হয়েছে)

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

14 Comments on “বলিউডের মাসালা সিনেমা”

  1. সমকাল ঈদ উপহারেই আপনার লেখাটা পড়লাম। অভিনন্দন 🙂
    ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা । ভালো থাকুন সব সময়

  2. ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’ অ্যাকশন মুভি না এবং ডন টু ‘রা ওয়ান’ এর পরে মুক্তি পায় ।
    আপনাকেও ঈদের শুভেচ্ছা 🙂

  3. দারুন।

    বিশেষ করে, ‘তাই বলে নকল করার প্রবণতাকে কাটিয়ে উঠতে না পারলে বলিউডের সিনেমা কেবল ব্যবসা-ই করে যাবে, বৈশ্বিক মানের শিল্প কখনো তৈরী করতে পারবে না’

    শুভেচ্ছা রৈল।

  4. দাবাং তো রিমেক না…দাবাং কে ই বরং সাউথ রিমেক করেছে…তামিল অস্থি…তেলুগু গাব্বার সিং!

    পোষ্টটা আরেকটু আপডেট করে আপনার ব্লগ পাঠকদ্র জন্য দেয়া দরকার ছিল।কোন মাফ করার সুযোগ নাই এখানে!!!

  5. ভাই, আমি কিছুদিন আগে আপনাকে হিন্দি ছিনেমার উপর একটা পুরা রিভিউ আশা করেসিলাম। আজ তার খানিক টা পুরন হল। অনেক শুভ কামনা রইল।

    1. হিন্দী সিনেমা তো ভাই কম দেখা হয়, তাই রিভিউ-ও লিখা হয় না।
      এই লেখাটা লোভে পৈড়া লেখা। সমকালের ঈদ সংখ্যার জন্য লিখছিলাম গত বছর, ওরা ছাপাইছে এই বছর 🙂

      ভালো থাকুন সাফায়াত 😉

  6. ভাই,আপনার কথাগুলো ভালো লাগছে।বলিউডি সমগ্রী আমার খুবই অপছন্দের।বলিউডকে সাধারনতো বাকা দৃষ্টিতে দিখি।
    বলিউডি মুভির মূল দর্শক কারা?আমি যেটা বিশ্বাস করি সেটা হলো,দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্য প্রাচ্য।একটা আর্টিকেল লিখার অনুরোধ করছি,যেটার শিরোনাম হবে,”দেশ বিদেশে বলিউডের দর্শক”,মানে ইন্ডিয়ার বাইরের মূলত কোন দর্শকগুলো থেকে ওরা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করে।
    আমি বলিউডি পন্যদ্রব্য এড়িয়ে চলে।তবে দুর্ঘটনাজনকভাবে তেরি জামিন পারের মতো হাতে গোনা কিছু মুভি হয়,বলিউডি দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে ওগুলো দেখি।

    1. স্বাগতম দারাশিকো’র ব্লগে 🙂 🙂
      দেখার দৃষ্টিকোন থেকে আপনার সাথে আমার অমিল নেই মামুন 🙂
      তবে ওদের রাইজিং নেচারকে আমি অস্বীকার করি না – তারা পারতেসে। দক্ষিন এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের দর্শকরা দেখুক না দেখুক, হয়তো এদের সবাই – কম বেশী ভারতীয়। কিন্তু খেয়াল করে দেখেন হলিউডের সিনেমাগুলোয় ভারতীয়রা কিন্তু আস্তে আস্তে হাজির হচ্ছে – মেজর চরিত্র হিসেবেও উপস্থিত হচ্ছে। সুতরাং, আমি আপনি যতই অপছন্দ করি না কেন – বলিউড বা ভারতীয়রা তাদের জায়গা ঠিকই করে নিচ্ছে।
      আমি বরং এই থেকে শেখার চেষ্টা করি। কাজ করতে হলে এভাবেই করতে হবে। আমার সিনেমা সে দেখুক না দেখুক – তার সিনেমায় যদি আমি গুরুত্বপূর্ন অবস্থানে উপস্থিত হতে পারি, তবেই বাংলাদেশ হিসেবে কিছুটা উন্নতি করা হয়েছে বলে বুঝতে পারবো 🙂
      হাতে গোনা মুভি আমিও দেখছি – কিছু মুভি দেখতেও হবে 🙂

      ভালো থাকুন মামুন, আবার আসতে ভুলবেন না 🙂

Leave a Reply to দারাশিকো Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *