টু কিল আ মকিংবার্ড (To Kill a Mockingbird): চাই বর্ণবাদমুক্ত পৃথিবী

টু কিল আ মকিংবার্ড ছবির দৃশ্য
টু কিল আ মকিংবার্ড ছবির দৃশ্য

সাদা আর কালো নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রাচীন। কোন এক অজানা কারণে সাদা হয়ে উঠেছে ভালোর প্রতীক, কালো মন্দ। এ কারণে চিত্রকলা থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রে পর্যন্ত নায়ক সাদা পোশাকে কালো পোশাকের ভিলেনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পোষাক আশাক থেকে শুরু করে জীবনের অন্যান্য অনুষঙ্গে এই সাদা কালো বেশ ভালো ভূমিকা পালন করে এবং দু:খজনকভাবে, মানুষের বর্ণ বা চেহারার রং-এও এই পার্থক্য বিদ্যমান।

প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের বর্ণ সাদা কালো স্কেলের বিভিন্ন পর্যােয় অবস্থান করলেও প্রকৃতি এখানে উপেক্ষিত, বর্ণ গৌরব এখানে ক্ষমতাবান। এ কারণে সাদা মানুষের চোখে কালোরা নিচু, ছোট, ঘৃনিত। এই দ্বন্দ্ব শুধু মানুষের মাঝে নয় ঈশ্বরের রূপ কল্পনায়ও এই দুই রং পাওয়া যায়। তাই কোথাও ঈশ্বরের রং কালো (ব্রুস অলমাইটি), কোথাও সাদা (সাদা গড এমন খুব বিখ্যাত সিনেমা নেই, টেন কম্যান্ডমেন্ডস নামের সিনেমায় একজন সাদা গড ছিলেন, আনক্রেডিটেড)।

রেসিজম নিয়ে এই ভনিতার উদ্দীপক হল ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’ সিনেমাটি। ১৯৬০ সালে হার্পার লি এই নামে উপন্যাসটি লিখেন। উপন্যাসটি খুবই সফল হয় এবং পুলিৎজার পুরস্কার জিতে নেয়। দু’বছর বাদে এই বইয়ের কাহিনী নিয়ে রবার্ট মুলিগান নির্মান করেন সিনেমা ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’।

উপন্যাসের মত সিনেমায়ও কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ১০ বছর বয়সী চরিত্র স্কাউটের মুখে। স্কাউটের সাথে আছে আরও দুই শিশু – একজন তার ভাই জেম, অন্যজন প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে আসা ডিল। মূলত এই তিন শিশুর শৈশব অভিযান এবং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে বর্ণবাদ, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয়গুলো। পরিচালকের ভরসার জায়গা ছিল দুটো – এক, বেশ বিখ্যাত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত কাহিনী এবং দুই, অভিনেতা গ্রেগরি পেক। বিখ্যাত এই বইয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত সিনেমাও সফল।

মাতৃহীন দুই ভাই বোন জেম এবং স্কাউটের সাথে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে আসা ডিল – এই তিনজনে মিলে বাড়ির আশে পাশে দস্যিপনা করে বেড়ায়। জিম এবং স্কাউট বর্ণনা দেয় আশেপাশের প্রতিবেশীদের – নিয়ে যায় তাদের বাবা অ্যাটিকাস ফিঞ্চ যে কোর্টে প্র্যাকটিস করেন সেখানে। পাশের বাড়িতে থাকে বু রেডলি, মানসিক প্রতিবন্ধী। শিশুসুলভ বর্ননা পাওয়া যায় জেম এর কন্ঠে – ‘সাড়ে ছ’ফিট লম্বা, কাঁচা কাঁচা বেড়াল ও কাঠবিড়ালি খায়, মুখের উপর বিশাল দাগ। দাঁতগুলো হলদে এবং পচে যাওয়া। চোখগুলো বেরিয়ে আছে।’

ভীতিকর এই মানুষটা যে বাড়িতে শিকলে বন্দী থাকে তার ধারে কাছে যাওয়াও যেন বিশাল অ্যাডভেঞ্চার। সব কিছুই তাদের ভালো বাবা অ্যাটিকাস ফিঞ্চ এর চোখ এড়িয়ে। পেশায় উকিল এই অ্যাটিকাস একদিন অনুরোধে টম রবিনসন নামের এক নিগ্রোর মামলার দায়িত্ব নেয়। অভিযোগ গুরুতর। একজন সাদা গরীব মেয়েকে ধর্ষণ করেছে টম। একজন সাদা হয়ে বর্ণবাদের উর্দ্ধে গিয়ে অ্যাটিকাস যখন টম রবিনসনের দায়িত্ব নেয় তখনই কাহিনী ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এর আগ পর্যন্ত টু কিল আ মকিংবার্ড সিনেমা কোন দিকে যাবে সে বিষয়ে তেমন কোন ইংগিত না থাকায় শিশুদের শিশুসুলভ অ্যাডভেঞ্চারই গুরুত্বপূর্ন হয়ে দাড়ায়।

অ্যাটিকাস চরিত্রে গ্রেগরি পেক এর অভিনয় অনবদ্য। এক দিকে সে যেমন মাতৃহীন শিশুদের পিতা এবং মাতা, অন্যদিকে সে একজন সচেতন দায়িত্বশীল মানুষও। চশমা পড়া দীর্ঘকায় অ্যাটিকাসের চেহারায়, ভংগিতে শিক্ষিত এবং মার্জিত ভদ্রলোকের পরিচয় স্পষ্ট। অ্যাটিকাস কেমন লোক তা জানা যায় প্রতিবেশী মিস মডি অ্যাটকিনসনের কথায় – He can do plenty of things… He can make somebody’s will so airtight you can’t break it. আদালতে টম রবিনসনের মামলার শুনানী দৃশ্য এবং বিচার টু কিল আ মকিংবার্ড সিনেমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। পক্ষ প্রতিপক্ষের জেরার মধ্য দিয়ে সত্যিকারের কাহিনীটি উঠে আসে সবার কাছে – টম রবিনসন যে সত্যিকারের দোষী নয়, ঘটনার শিকার মাত্র, তা দর্শকের বোধকরি আগেই জানা ছিল, জানা ছিল না আসল ঘটনাটুকু।

কিন্তু বিচারের রায়ে যুক্তি আর সততার চেয়ে বড় জায়গা নিল সেই অহংবোধ, সাদা চামড়ার গরীমা। তাই টম রবিনসনের বিপক্ষেই গেল রায়। কিন্তু ক্ষনিক পরেই যখন জানা গেল পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে টম নিহত হয়েছে – তখন স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানের দর্শক হিসেবে প্রশ্ন জাগে – সত্যিই কি টম পালাচ্ছিল? হয়তো সে যুগে ‘ক্রসফায়ার’ খুব পরিচিত কোন শব্দ ছিল না আর তাই টমের মৃত্যুর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। সিনেমার সেরা দৃশ্যটি এই কোর্টরুমেই – বিচারের রায়ে জয়ী সাদারা নিরবে আদালত কক্ষ ত্যাগ করার পরে অ্যাটিকাসের সম্মানে সব নিগ্রোরা একে একে দাড়াল। এই স্যালুট যেন বর্নবাদের বিরোধিতায় একজন পরাজিত মানুষের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা।

টু কিল আ মকিংবার্ড সিনেমার শুরুতে টাইটেল দৃশ্যটা চমৎকার। বিগ ক্লোজআপে একজন শিশুর খেলনার বাক্সে নানা রকম বস্তুর সমাহার। তার মধ্যে আছে ঘড়ি, পুতুল, মার্বেল ইত্যাদি। সিনেমার নামটা পাওয়া যায় শুরুর দিকে যখন অ্যাটিকাস সন্তানদেরকে তার প্রথম বন্দুক ব্যাবহারের গল্প শোনায়। বন্দুক দিয়ে মকিংবার্ড (এক ধরনের পাখি যা অনুকরণ করার জন্য বিখ্যাত) মারা এক প্রকার পাপ কারণ mockingbirds don’t do anything but make music for us to enjoy. They don’t eat people’s gardens, don’t nest in the corncrib, they don’t do one thing but just sing their hearts out for us.

এই সংলাপের ভাব সম্প্রসারিত হয় সিনেমার শেষে যখন বব কর্তৃক জেম ও স্কাউট আক্রান্ত হওয়ার পরে পাগল বু রেডলি তাদেরকে উদ্ধার করে এবং এই প্রক্রিয়ায় নিহত হয় বব। শেরিফ ঠিক করেন বু-কে এই হত্যায় দোষী করবেন না কারণ এতে নিহত বব এর কোনই উপকার হবে না। যুক্তিটা খুব গ্রাহ্য না হলেও আমরা বুঝতে পারি মকিংবার্ডস রূপী বু রেডলির ভূমিকা। একজন পাপীর শাস্তি পাওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু যে ভালো মন্দ কিছুই করে না তাকে শাস্তি দেয়াটাও পাপ হতে পারে।

সব মিলিয়ে টু কিল আ মকিংবার্ড বেশ সফল সিনেমা। অবশ্য যদি দর্শকরা টমকে অন্যায় ভাবে জেল থেকে ছিনিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টার দৃশ্যে স্কাউটের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন না তোলেন। বাচ্চারা খুব ভালো অভিনয় করেছে। স্কাউট চরিত্রে রূপদানকারী মেরী সেরা সাপোর্টিং চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অস্কারের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। মেরী অস্কার না পেলেও গ্রেগরি পেক পেয়েছিলেন সেরা নায়ক হিসেবে, সিনেমাটি জিতেছিল আরও দুইটি অস্কার। এছাড়া বিভিন্ন তালিকায় উপরের দিকে অবস্থান তো রয়েছেই। সেই বোধ জাগ্রত হোক সবার মাঝে যা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসে পাওয়া যায় – কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো ক্যানে?

আমার দারাশিকো ডট কম- বারবার বেড়িয়ে পেজ হিট বাড়িয়ে দিচ্ছেন যে কজন মানষ তাদের একজন পুষ্পিতা। তার রিকমেন্ডেই এই সিনেমাটা দেখা। এমন একটি অসাধারণ সিনেমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা। এই লেখাটা পুষ্পিতার জন্য

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

17 Comments on “টু কিল আ মকিংবার্ড (To Kill a Mockingbird): চাই বর্ণবাদমুক্ত পৃথিবী”

  1. কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো ক্যানে?
    সেইরকম লিকসেন ভাই ……………………………। ভালো লাগলো পরে । কীপ ঈট আপ । 😀

    1. এই পোলাডার ক্যাপিট্যাল লেটার ব্যবহার করার দোষ গেল না। ইট লিখছে ঈ দিয়া 🙁

      আপ রাখবো ইনশাল্লাহ। সাথে থাইকেন 🙂

      1. 😛
        স্যরি ভাই । কিপ ইট আপ !!!!!!!!!!!!!! এইবার ঠিক আছে !!!!!!!!!!!!! 😀 😉

  2. বাইজান… ঠিক বুঝতেসি না কি বলব! আসলেই! অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আর আমি খুব খুশি যে আপনি এই মুভি টা দেখসেন।

    লেখা বরাবর এর মতই সচ্ছন্দ। কেউ না দেখলেও তার মধ্যে দেখার আগ্রহ তৈরী হবে। মুভি টার সারবস্তু টা সবার জন্যই প্রযোজ্য । যে সব মুভি দেখে আমি ভীষণ রকম ইনফ্লুয়েন্সড, এইটা তার মধ্যে অন্যতম।

  3. অ্যাজ ইউজাল দারুন লিখেছেন দারাশিকো ভাই 🙂

  4. “mockingbirds don’t do anything but make music for us to enjoy. They don’t eat people’s gardens, don’t nest in the corncrib, they don’t do one thing but just sing their hearts out for us.” অসাধারণ লাইন।

  5. মাস্টারপীস একখান সিনেমা! মাস খানেক আগে আপনার রিভিউ পড়েই ডাউনলোড করেছিলাম, আজই দেখার সৌভাগ্য হলো।
    অনেক ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।

Leave a Reply to Azad Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *