কেন আমি ভারতীয় সিনেমা আমদানীর বিরোধিতা করি?

বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা আমদানীর বিরোধিতা করে আমি এ পর্যন্ত দুটো পোস্ট দিয়েছি। ভগবান বাংলাদেশী সিনেমাকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো এবং রাজনৈতিক ডট কম সম্পাদিত-প্রকাশিত দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে সামহোয়্যারইনব্লগে এবং চতুর্মাত্রিকে এই ব্লগদুটো প্রকাশিত হবার পরে নানা মন্তব্য পেয়েছি। কোন এক মন্তব্যের জবাবটাই এখন একটা পোস্ট হয়ে গেল

দুয়ার বন্ধ করে আসলেই শিল্প চর্চা হয় না যদি সেই শিল্পের ইংরেজী হয় ‘আর্ট’, কিন্তু শিল্পের ইংরেজি যদি হয় ‘ইন্ডাস্ট্রি’ তবে অবশ্যই দরজা বন্ধ করে হতে পারে – আমরা যে ভারতীয় সিনেমা আমদানী করতে যাচ্ছি সেই ভারতেই এই এক্জাম্পল ভুড়ি ভুড়ি।

অনেকেই বলছেন, বস্তাপচা সিরিয়ালগুলোকে যেখানে বন্ধ করতে পারি নি অথচ সেটাই সর্বপ্রথম উচিত কাজ, তখন ভারতীয় সিনেমা আমদানী বন্ধ করে কি হবে? ভারতীয় বস্তাপচা সিরিয়ালগুলো আমরা বন্ধ করতে পারি নাই সত্যি, কিন্তু এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে এই টিভি চ্যানেলগুলোই এক/দেড় দশক পরে বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা আমদানীর পথ করে দিল। তাছাড়া, টিভি চ্যানেল বন্ধ করতে পারিনি বলে সিনেমাকে সুযোগ করে দেয়াটা যৌক্তিক নয়, অন্তত: ঠিক এই যুক্তিতে।

ভারতীয় সিনেমা আমদানী নিয়ে অদিতির মন্তব্য

ভারতীয় সিনেমা আমদানী নিয়ে অদিতি যে চারটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন তার সাথে দ্বিমত করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নাই। সত্যিই তো, প্রদর্শকরা কেনো বিনিয়োগ করেন না? প্রথম সিনেমা মুখ ও মুখোশ নির্মানের সময় বলাকা সিনেমাহল বিনিয়োগ করেছিল, পরে আরও বেশ কিছু সিনেমায় কিন্তু তার পর? এটাও সত্যি যে সিনেমায় যে অশ্লীলতা বেড়েছে তা খুবই ভয়াবহ, এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই অশ্লীলতা হলগুলোর মানোবনতির কারণ হয়েছে, মধ্যবিত্ত দর্শককে হল থেকে বাসামুখী করেছে এবং সেই সময়ে তৈরী হ্ওয়া ধারণা এখনো দর্শককে হলে ফিরিয়ে আনতে পারছে না এবং হলগুলোর অবস্থার উন্নয়ন ও ঘটাতে পারছে না – পুরোটাই একটা সাইকেল ইফেক্ট।

৪০ বছর সরকার প্রদত্ত একতরফা সুবিধার কথা বলছেন কেউ কেউ, অস্বীকার করার সুযোগ নেই এখানেও, কিন্তু এ প্রসঙ্গে অদিতির শেষ দুটো প্রশ্নই উত্তর হয়ে যায়। সত্যিই তো, সরকার অনুদান দিচ্ছে যে পরিমানে সেই অনুদানে একটা সিনেমাও হয় না, গেরিলা অনুদান প্রাপ্ত সিনেমা ছিল- যতটুকু জানি এই অনুদানের পরিমান ৪০ লক্ষ টাকা, কিন্তু সিনেমা নির্মানে ব্যয় প্রায় ৪ কোটি টাকা। এত অল্প অনুদানে কিভাবে একটা ভালো সিনেমা তৈরী হয়?

৪০ বছর পার হয়ে গেল – কোন সরকারই এখন পর্যন্ত একটা সুষ্ঠূ নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে নি, নির্মাণ হয়নি একটি ফিল্ম ইন্সটিটিউট। সিনেমার ব্যয়কে সংকোচন করার উদ্দেশ্যে ফিল্ম ফরম্যাটকে ডিজিটাল এবং ডিজিটালকে ফিল্মে রূপান্তরের কোন সুযোগ নেই। ফিল্ম থেকে ডিজিটালে রূপান্তরের যন্ত্রপাতি (টেলিসিনে মেশিন) দেশে আনা হয়েছে কিন্তু পরের অংশটি (রিভার্স টেলিসিনে মেশিন) ঠিকই মাদ্রাজে-মুম্বাইয়ে গিয়ে করতে হয়। খরচ কিন্তু খুব একটা কমে নি। যখন আমাদের দেশে সিনেমা নির্মানের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কমে যাবে, তখন সরকার এখন যতটা মনযোগ দিচ্ছে তার চেয়েও কম বিনিয়োগ করবে। ফলাফল কি দাঁড়াবে? সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি তখন পুরোটাই কি ভারত নির্ভর হয়ে পড়বে না?

ইন্টারনেট আর পাইরেটেড ডিভিডির কল্যানে হিন্দী সিনেমা দেখাকে উদাহরণ হিসেবে কেউ কেউ উপস্থাপন করছেন এবং এর ভিত্তিতে কেনো ভারতীয় সিনেমা আমদানী করা হবে না সে বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে পাইরেটেড আর ইন্টারেনেটের মাধ্যমে প্রাপ্ত সিনেমা থেকে কোন অর্থ ভারতে যায় না। কিন্তু আমদানী করার মানে হলো দেশীয় অর্থ ভারতে পাঠিয়ে তারপর বিনোদনের ব্যবস্থা করা। এই যুক্তিতে কি ভারতীয় সিনেমা আমদানীর বিরোধিতা করা যায়?

আমি খুব অবাক হয়ে যাই যখন ইরানের দিকে তাকাই। একটা ইসলামী বিপ্লব হয়ে যাওয়ার পরে যেখানে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিই বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে সেটা দিনকে দিন সমৃদ্ধশালী হচ্ছে। কেন? সরকারের ভূমিকাটা দেখুন, বোঝা যাবে।

সবশেষে, আমাদের এই ক্ষুদ্র বাংলাদেশে আমাদের ক্ষমতা এতই অল্প যে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় খুব কম জিনিসই আমরা ভালোভাবে বানাতে পারি। ভেবে দেখুন তো- এই যুক্তিতে যদি বাংলাদেশের সব কিছুই আমদানী করতে শুরু করি তাহলে কি অবস্থা দাঁড়ায়? ইন্দোনেশিয়ার এক ছেলের সাথে আমার মাঝে মধ্যে চ্যাটিঙ হয়, সেও সিনেমায় খুব আগ্রহী। তাকে যখন আমি বলি বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৯০ টা সিনেমা মুক্তি পায়, তখন আমার বেশ ভালো লাগে, মনে হয়, আমাদের একটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আছে – আর কিছুদিন পরে কি আমি এই কথাটা বলতে পারবো?

ভারত সহ পৃথিবীর সব দেশ থেকে সিনেমা আমদানী অবশ্যই করা যেতে পারে, কিন্তু তার জন্য একটা সময় দরকার। যেই ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমরা তেল গ্যাস রপ্তানীর বিরোধিতা করছি, সেই ভবিষ্যতটাই আমাকে ভারতীয় সিনেমা আমদানীর বিপক্ষে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করে – আমি অনেক সহ্য করে ভেতরের কষ্টগুলো চেপে গিয়ে বস্তাপচা সিনেমা নির্মাতা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে কথা বলি।

আমি সবসময়ই তা বলবো।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

3 Comments on “কেন আমি ভারতীয় সিনেমা আমদানীর বিরোধিতা করি?”

  1. খুব যুক্তিপূর্ণ উদাহরণ দিয়েছেন… আপনাকে ধন্যবাদ।।

    কিছু কিছু মুনাফালোভী মানুষ দেশ ও দেশের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করেই, দেশের শিল্প সংস্কৃতির প্রতি হুমকিস্বরূপ হিন্দি বা অন্যান্য সিনেমা আমদানির কথা বলছে।। যুক্তি হিসেবে তারা “প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন” কথাটিকে বারবার সামনে নিয়ে আসছে… কিন্তু তারা বুঝতে চাইছে না, অসম শক্তির মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে দুর্বল কখনো টিকে থাকতে পারে না, থাকলেও তাকে দুর্বল হিসেবেই থাকতে হয়।।

    এ অবস্থার উন্নয়নের জন্য আমি সেইসব মুনাফালোভীদের বিদেশী সিনেমায় বিনিয়োগ না করে বাংলা সিনেমায় বিনিয়োগ করার আহ্বান জানাব, এতে দেশের সংস্কৃতি কিছুটা হলেও এগিয়ে যেতে পারবে, দেশের টাকা দেশে থাকবে, দেশের সংস্কৃতি রক্ষা হবে…

    আর সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক ও পরিবেশকদের অনুরোধ জানাব, আপনারা সিনেমার পরিবেশ উন্নয়নে মনোযোগ দিন। সিনেমা কিছু কুরুচিপূর্ণ ‘মানুষের’ জন্য না বানিয়ে, বিশাল মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য বানান।। দরকার হলে হলিউডের সিনেমা, ইরানি সিনেমা নকল করুন (যতখানি সম্ভব)… এভাবে নকল করতে করতে আপনারাও একদিন উচ্চমানের মৌলিক সিনেমা বানাতে পারবেন…

    সরকারের প্রতি আমার কোনো দাবি নাই… কারণ যে সরকার দেশের সংস্কৃতি রক্ষা করার বদলে, বিদেশী সংস্কৃতি আমদানী ও প্রচলনে অতিমাত্রায় আগ্রহী তাদের কাছে দাবি নিয়ে যাওয়া আর “অরণ্যে রোদন” একই কথা…

    1. ধন্যবাদ রকীব।
      সরকারের কাছে অনুরোধ করা আর অরন্যে রোদন সত্যিই একই কথা। কিন্তু তারপরেও সরকারের কাছে যেতে হবে বিশেষত: এফডিসির কারীগরী উন্নয়নের জন্য। ব্যাক্তিমালিকানায় এর উন্নয়ন সম্ভব নয় এ কারনে যে এখঅনে মুনাফার সুযোগটা তুলনামূলকভাবে কম। তাছাড়া, সরকার এই উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহন না করায় উল্টোকাজে অংশ নিচ্ছে -সিনেমা আমদানী করার চেষ্টা করছে।

      তবে সত্যিই, যদি প্রদর্শকরা সিনেমায় বিনিয়োগ করতো তবে হয়তো অনেক ভালোই হতো। আবারও ধন্যবাদ রকীব, আবারো আসবেন 🙂

Leave a Reply to দারাশিকো Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *