সিনেমাটোগ্রাফার রজার ডেকিন্স তার জীবনে ৬০টির বেশী পুরস্কার পেয়েছেন, এর মাঝে তিনটি বাফটা অ্যাওয়ার্ড। এগারোবার অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বা অস্কারের নমিনেশন পেলেও একবারও জিততে পারেন নি। তার ফটোগ্রাফি ডিরেকশনে নির্মিত সিনেমাগুলোর মধ্য খুব বিখ্যাত কিছু সিনেমা হল – দ্য শশাঙ্ক রিডেমশন, নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান, স্কাইফল, ট্রু গ্রিট, আ বিউটিফুল মাইন্ড, দ্য রিডার, রিভ্যলুশ্যনারী রোড ইত্যাদি। গত ১৪ এপ্রিল বিবিসি-তে সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে তার অভিজ্ঞতালব্ধ ১০টি টিপস দিয়েছেন রজার ডেকিন্স – এই লেখাটা মূলত সেই টিপসগুলোরই দারাশিকো-ভার্সন।
১. জীবন সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা
সিনেমাটোগ্রাফার যদিও পরিচালকের ডান হাত হিসেবে কাজ করেন, জীবন সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে ভালো সিনেমাটোগ্রাফি করা সম্ভব নয়। রবার্টের মত সিনেমাটোগ্রাফি শেখা যায় না, নকলও করা যায় না। জীবনকে কিভাবে দেখছি সেটাকেই তুলে ধরা হয় সিনেমাটোগ্রাফিতে – সুতরাং জীবনকে দেখার অভিজ্ঞতা বেশী প্রয়োজন, এমনকি কারিগরী জ্ঞানের চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
২. বেছে নেয়ার মনোভাব
ডিকেন্স সম্প্রতি অ্যাঞেলিনা জোলি পরিচালিত একটি ছবির ফটোগ্রাফি ডিরেকশন দিয়েছেন। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে সিনেমায়, কিন্তু তিনি খুশী। কারণ নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করতে পেরেছেন। ডিকেন্স সাধারণত চরিত্র নির্ভর স্ক্রিপ্টে কাজ করতে পছন্দ করেন, অ্যাকশন সিনেমায় তার আগ্রহ কম। অনেক অনেক সুযোগ থেকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করার মানসিকতা থাকা দরকার বলে রবার্ট মনে করেন।
৩. সতর্কতার সাথে সহযোগী বাছাই
কোয়েন ব্রাদার্সের সাথে মোট এগারোটি ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফিতে কাজ করেছেন রবার্ট ডিকেন্স। তাদের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক – তাদের যে কোন ধরনের কাজে সহযোগিতা করতে রাজি আছেন রবার্ট ডিকেন্স। স্কাইফলের পরিচালক স্যাম মেন্ডেসের সাথে কাজ করতেও তার ভালো লেগেছে, কিন্তু অন্য কোন বন্ড মুভিতে কাজ করার ব্যাপারে তার আগ্রহ নেই। নতুন কিছু দেয়ার নেই বলে মনে করেন ডিকেন্স, এ কারণেই কাজ না করার সিদ্ধান্ত। কাদের সাথে কাজ করছি – তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কাজ করার আগে সহযোগি বাছাই করার কাজটি যত্নের সাথে করা উচিত বলে রবার্ট ডিকেন্স মনে করেন।
৪. সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ
সিনেমার কাজ এলে সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন ডিকেন্স। তার প্রায় সব সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময় স্ত্রী জেমস ইলীসের সাথে পরামর্শ করে নেন রবার্ট। বিশ বছরের সংসার তাদের, সিনেমা সম্পর্কে আগ্রহও প্রায় একই রকম। কোন কাজ করার আগে সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে দেখার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন রবার্ট ডিকেন্স।
৫. অন্যদের নকল না করা
প্রত্যেকের কাজ করার পদ্ধতি আলাদা। সবাই নিজেদের মত করে লাইট ঠিক করে নেন, লেন্স ও অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করেন। একজনের কাজ আরেকজনের পক্ষে কপি করা এবং ভালো করা সম্ভব না। ফলে, নিজে একজন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। নিজের মত করে সব কিছু শিখে নিতে হবে, তবেই ভালো করা সম্ভব হবে, নকল করে শেখা সম্ভব নয়।
৬. লাইটিং এর গুরুত্ব অনুভব করা
দ্য শশাঙ্ক রিডেমশন দেখে একজন সিনেমাটোগ্রাফার বন্ধু বলেছিল – কাজটা সুন্দর হয়েছে কিন্তু কোন লাইটিং করা হয় নি। রবার্ট ডিকেন্স আহত হয়েছেন এই মন্তব্যে, কারণ তিনি জানেন – প্রায় সব দৃশ্যেই, এমনকি বহির্দৃশ্যেও লাইট ব্যবহার করতে হয়েছে তাকে। অথচ সিনেমাটোগ্রাফার বন্ধুটি ভেবেছেন ন্যাচারাল আলোতে শ্যুট করা হয়েছে। শুধু চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য আলো নয়, বরং সিনেমাটোগ্রাফারকে আলোর সাহায্যে এমন একটি দুনিয়া তৈরী করতে হয় যা একটি নির্দিষ্ট মুডকে গ্রহণ করবে, চরিত্রগুলোকে সেই আলোতে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করবে, দর্শকও গ্রহণ করবে। যে কোন সিনেমাতেই লাইটিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
৭. যোগ্যতার কম কাজ নয়
যখন কাজের অনেক চাপ, দৈনিক ১২ থেকে ১৮ ঘন্টাও কাজ করতে হচ্ছে, তখন কাজের প্রতি যত্ন কমে যেতে পারে। মনে হতে পারে, এতটুকু করলেই চলবে, এর বেশী প্রয়োজন নেই। রবার্ট ডিকেন্সের পরামর্শ হচ্ছে – যত কষ্টই হোক না কেন, নিজের পক্ষে যতটুকু দেয়া সম্ভব, ততটুকুই দেয়া উচিত। এতে পরে আফসোস করতে হবে না।
৮. নতুন প্রযুক্তির সাথে পরিচয় দরকার, তবে স্টোরিটেলিং ভুলে নয়
সবসময় প্রযুক্তির সাথে আপডেটেড থাকতে হবে। প্রযুক্তি খুব দ্রুত বদলায়। কিন্তু এই প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ৈ নিতে গিয়ে গল্প বলার যে পদ্ধতি সেটা ভুলে গেলে চলবে না, কারণ ওটা খুব বেশী পাল্টায় না। ডিকেন্সের মতে প্রযুক্তিতে অনেক পরিবর্তন ঘটলেও আসলে তেমন ঘটে নি, কারণ সেই আগের মতই লাইট, ফ্রেম, ক্যামেরা মুভমেন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে সিনেমা নির্মান চলছে। টেকনলজি হল ছবি আঁকার ব্রাশের মত, এটাই শেষ নয়।
৯. শ্যুটিং এর জন্য আরামদায়ক পোশাক
ডিকেন্সের তিন জোড়া জিন্স এবং দশটি সাদা শার্ট আছে। তিনি সবসময় এই পোশাকেই থাকেন। মাত্র দশমিনিটের নোটিশে বাসা থেকে বের হওয়া তার জন্য সহজ, কারণ তিনি জানেন তিনি কি পড়ে বের হবেন। কি পড়ছি তার তুলনায় পড়ে কেমন অনুভব করছি, বা কমফোর্ট্যাবিলিটি, বেশী গুরুত্বপূর্ণ ডিকেন্সের কাছে।
১০. বাজে ঘটনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা
অনেক সময় অনেক বাজে ঘটনা ঘটেছে ডিকেন্সের জীবনে। সিনেমায় কাজ শুরু করার পর বাদ পড়েছেন। এই সময়গুলো খারাপ, জীবনের জন্য সংগ্রামমুখর। কিন্তু এগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছেন ডিকেন্স। সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে পারাটাই সাফল্য।
ডিকেন্স আশা করেন খুব শীঘ্রই আবার কোয়েন ব্রাদার্সের সাথে কাজ করবেন। নিজের জীবনকে এবং ক্যারিয়ারকে ভালোবাসেন ডিকেন্স, এবং তার আরও অনেক কিছু করার আছে – এমন বক্তব্যেই লেখার ইতি টেনেছেন রবার্ট ডিকেন্স।