নার্সিসিজম এবং সোশ্যাল মিডিয়া

নারায়নগঞ্জের স্কুলছাত্র ত্বকী হত্যাকান্ডের পর গল্পটা বলেছিলাম, আরও একবার বলি। 

এক ছেলে কম্পিউটারে মজা করতে গিয়ে কিল বিল কিল বিল কিল বিল লিখে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছিল। ছেলেমানুষী কর্মকান্ড, কিন্তু আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এই কাজকে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে হত্যা করার নির্দেশনা হিসেবে চিহ্নিত করে সেই ছেলেকে খুজে গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। বছর কয়েক পরে, আরেকটা ঘটনা ঘটল – একদম আমার নিজের বাংলাদেশে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইমেইল করে হত্যার হুমকীয় দিয়ে ফেলল এক তরুণ ছেলে। টক অব দ্য কান্ট্রি! অল্প কদিন পরেই, সম্ভবত তিন দিন, বাংলাদেশের পুলিশ সেই ছেলেটাকে ধরে ফেলল। ঢাকা শহরের কোন এক সাইবার ক্যাফে থেকে সে মেইলটা করেছিল।

সেই পুরানো গল্পে নতুন একটা চ্যাপ্টার যুক্ত হল দিন কয়েক আগে। এবারের ঘটনাটা ঘটিয়েছে এক ডাচ কিশোরী, বয়স মাত্র ১৪ বছর। টুইটারে আমেরিকান এয়ারলাইন্সকে উদ্দেশ্য করে সে একটা হুমকী দিয়েছে এবং এয়ারলাইন্স সারাহকে জানিয়েই হুমকীর বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছে। ফলাফল, সারাহ নামের সেই কিশোরী গ্রেপ্তার হয়েছে, তার টুইটার অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দেয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সারাহ অনুনয় বিনয় করে অনেকগুলো টুইটে তার ভুল এবং বোকামী স্বীকার করেছে, এমনকি এই পরিস্থিতিতে তাকে সাহায্য করার জন্য লইয়ার চেয়েও টুইট করেছে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তার টুইটটি বিশ হাজারের বেশীবার শেয়ার হয়েছে, তার ফলোয়ার সংখ্যা ১৫ হাজার বেড়েছে, কিন্তু গ্রেপ্তার ঠেকাতে পারে নি। (তথ্য ও ছবি: মিরর)
গ্রেফতারের সংবাদ প্রকাশের সাথেই একটা ছোট্ট প্রশ্ন করে পাঠকের ভোট চেয়েছে মিরর পত্রিকা। ভোটার সংখ্যা জানা না গেলেও ভোটের রেজাল্ট পাওয়া গেল সাথে সাথেই – ৭১ শতাংশ ভোটার মনে করেন টুইট থ্রেট দেয়ার জন্য সারাহর শাস্তি হওয়া উচিত নয়। সম্ভবত প্রত্যেকেই সারাহ’র বয়সের দিকটি বিবেচনা করে তাদের সমবেদনা প্রকাশ করেছে, আমি নিজেও তাই করেছি। 
সারাহ এই কাজ কেন করল সে ব্যাপারে সে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়েছে – এই টুইট সে করে নাই, তার বান্ধবী করেছে; সে মজা করতে চেয়েছিল, মোবাইলে ড্রাফট করা ছিল এবং মোবাইল অটোমেটিক পোস্ট করে দিয়েছে ইত্যাদি। আমি এই কারণগুলোর বাহিরে যে কারণটা খুঁজে পাই তা হল – সারাহ তার ফলোয়ারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল। এমন একটা কিছু যা তার অনুসারীরা রিটুইট করবে, ফেভারিট লিস্টে নেবে এবং এর ফলে আরও নতুন নতুন ফলোয়ার আসবে – সারাহ’র পপুলারিটিও বাড়বে! সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশ এই উদ্দেশ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এই মনোভাবকে ‘রাইজ অব নার্সিসিজম’ হিসেবে অভিহিত করছেন এবং, নার্সিসিজম মনোভাব বৃদ্ধির পেছনে ফেসবুক সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াকে বেশী দায়ী করছেন।

লিজা ফায়ারস্টোন নামের এক পিএইচডি-ধারীর এক আর্টিকেল পড়ার সুযোগ হল সেদিন। সেখানে তিনি বিভিন্ন রেফারেন্স দিয়ে নার্সিসিজম মনোভাব গড়ে উঠার পেছনে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা তুলে ধরেছেন। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-র দশকে জন্মগ্রহণকারীদের ‘জেনারেশন মি’ হিসেবে চিহ্নিত করে একজন গবেষক দেখিয়েছেন – ১৯৮০র তুলনায় বর্তমানে শারীরিক স্থুলতার পাশাপাশি নার্সিসিজমও সমান হারে বেড়েছে। ফেসবুকে অনেক বন্ধু থাকা, বিভিন্ন ছবিতে নিজেকে ট্যাগ করা এবং কিছু সময় পর পর স্ট্যাটাস দেয়া নার্সিসিস্ট মনোবৃত্তির পরিচায়ক। তবে, গবেষকরা এও বলেছেন – শুধু সোশ্যাল মিডিয়াই দায়ী নয়, আরও প্রভাবক আছে, তবে সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার তুলনায় কম প্রভাব বিস্তারকারী।

“Narcissists use Facebook and other social networking sites because they believe others are interested in what they’re doing, and they want others to know what they are doing.” – Laura Buffadi, a postdoctoral researcher at the Universidad de Dueto in Bilbao, Spain

আত্মকেন্দ্রিকতার এই ব্যাধি ভয়াবহ যার কিছু কিছু দিক বিভিন্ন ঘটনায় সামনে চলে আসে, যেমন সারাহ’র ঘটনা। গবেষকরা এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার নানাবিধ সমাধান প্রদান করছেন,  বিভিন্ন রকম গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সমাধানের উপায় যাই আসুক না কেন – সমাধান নির্ভর করবে সেই রোগীর উপরেই। একটু সচেতন হয়ে উঠে অপরের মতামতকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করে লোককে দেখানোর মানসিকতা দূর করতে পারলেই ‘জেনারেশন মি’-র সদস্যরা ভালো কিছু করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।

আমি নিজেও ‘জেনারেশন মি’ সদস্যভুক্ত এবং নার্সিসিস্ট। চিকিৎসা চলছে, দোয়াপ্রার্থী।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *