গোপনে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ

‘ফেসবুকে নাই, গুম হয়ে গেলেন কিনা’ – নিশ্চিত হওয়ার আগ্রহে এক বড় ভাই ফোন দিলেন আজকে। গুম করে নি কেউ – ভাইকে হতাশ করতেই হল! কুশল বিনিময়ের মাঝে জিজ্ঞেস করলাম – ভাবী কেমন আছেন? উত্তরে ‘ভালো’ বলার পর ভাই যোগ করলেন, ‘একটা কথা আছে, আপনাকে বলা যায়, আর কাউকে বলি নাই …’।

এই ধরনের কথাগুলো শোনার পর আমার খুশী খুশী লাগে। ভাই বিয়ে করেছেন বছর পার হল কিনা ঠিক হিসেব করতে পারছি না। এর মাঝেই কেউ যদি এ ধরনের কথা বলে তাহলে বুঝতে হবে আমি আরেকবার আংকেল হতে যাচ্ছি। আমি উৎফুল্ল গলায় বললাম, ‘না না বলতে পারেন, কোন সমস্যা নাই।’ ভাই আমার উৎসাহে বালতিভর্তি পানি ঢেলে দিয়ে বললেন, ‘আমার বিয়েটা বোধহয় টিকছে না।’

চট করে অনেকগুলো ঘটনা রিওয়াইন্ড হয়ে গেল মনের পর্দায়। বিয়ের আগে ভাই এবং তার কথাবার্তা, তারপর হঠাৎ করে ভাইয়ের বিয়ে। আপডেটগুলো ফেসবুকেই পেতাম – ছবি আর স্ট্যাটাসে। সুখী দম্পত্তি। বাস্তবতা ভিন্ন। অল্প কথায় ভাই ঘটনা জানালেন। ভাবীর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের সময় গোপন করে গিয়েছিলেন সেই কথা। এখন ভাবীর সাথে সেই ছেলের যোগাযোগ হয়। বোঝানোর পরও ফেরানো যাচ্ছে না। বিচ্ছেদ ছাড়া অন্য কোন সমাধানে পৌছানো সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ, তবে চেষ্টা চলছে।

আমি জানি না ভাবীর সেই বিয়ে গোপনে হয়েছিল কিনা, কিন্তু ভাইয়ের দেয়া এই মনখারাপের খবরে আমার আরও কিছু ঘটনা মনে পড়ে গেল। এক জুনিয়র ভাইয়ের সাথে পরিচয় সম্পর্ক প্রায় পাঁচ বছর, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার কাছে স্বীকার না করলেও জানি যে মেয়েটির সাথে তাকে ক্যাম্পাসে প্রায়ই দেখা যায় তাকে সে বিয়ে করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষেই। হাতে গোণা কয়েকজন বন্ধু ছাড়া এই বিষয়টি কেউ জানে না। যেহেতু ক্যাম্পাসে প্রেম খুবই সিদ্ধ বিষয়, তাই এ নিয়ে কারও মনে প্রশ্ন জাগে নি। এই সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত পারিবারিকভাবে সবাইকে জানিয়ে সত্যিকারের বিয়েতে পৌছুবে কিনা সেই নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না, কারণ ইদানিংকালে শুনেছিলাম – সেই সম্পর্কেও ফাটল ধরেছে।

আরেক বন্ধুর কথা বলি। সে মেয়ে। চাকরী নিয়ে সমস্যায় আছে জানতাম, কিন্তু সে যে বিবাহিত তা জানা ছিল না। হঠাৎ-ই একদিন জানালো। এ-ও জানালো, বিয়ের পর তারা একসাথে একই বাসায় থাকলেও দুজনের পরিবারের কেউ-ই জানে না বিয়ের ব্যাপারে। ভবিষ্যতে দুই পরিবারকে জানিয়েই পারিবারিকভাবে বিয়ের পরিকল্পনা তাদের। কিন্তু ফাটল দেখা যাচ্ছে এই সংসারেও। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটির চূড়ান্ত পর্যায়ে সেপারেশন-ডিভোর্সের পরিকল্পনাও তারা করছেন।

মজার ব্যাপার হল, জুনিয়র ভাই এবং বান্ধবী – দুজনেই ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম সম্পর্কে অনুরাগী এবং বিয়ে করেছেন ভালোভাবে ইসলামকে মেনে চলার জন্য। খটকা লাগে এখানেই। বিয়ের ব্যাপারে ইসলামে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক গুরুত্বের পাশাপাশি সামাজিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিয়ের ঘটনাকে সকলের মাঝে জানিয়ে দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে যেন বিবাহিত এই দুই নারী ও পুরুষকে দেখে সকলের শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়, সমাজে অনাচারের প্রসার না হয়। অথচ, গোপনে বিয়ে থেকে ব্যক্তিগত কল্যাণ লাভ হলেও সামাজিক কল্যাণের সুযোগ থাকে না, বরং অকল্যাণ হয়। ব্যক্তিগত কল্যাণের জন্য সামাজিক অকল্যাণের কারণ হওয়া যৌক্তিক নয়।

গোপন বিয়ের ক্ষেত্রে এক ধরনের অন্যায় সুযোগ নেয়ার মানসিকতা কাজ করতে পারে। যদি কখনো পরিবার বিয়ে মেনে না নেয়, কিংবা তারা দুজনেই যদি মানিয়ে নিতে না পারে, তাহলে গোপন বিয়ের মতই গোপনেই বিচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের গোপন বিয়ে এবং বিচ্ছেদই পরবর্তীতে সমস্যা তৈরী করার সুযোগ করে দেয়, পারিবারিকভাবে পছন্দ করে বিয়ে করা ভাইয়ের মত সংসার জীবনের একবছরের মধ্যেই দুঃখজনক বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

বর্তমানে আমরা যে সমাজে বাস করছি সেখানে বিয়ে খুবই কঠিন একটি প্রক্রিয়া। বিনা খরচায় বছরের পর বছর প্রেমের সম্পর্ক বহাল থাকলেও কারও আপত্তি হয় না, কিন্তু জাকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান করতে না পারলে ইজ্জত থাকে না। এছাড়া সামাজিক অন্যান্য সংস্কারের অনুসরণ তো আছেই। যে সমাজে বিয়ে কঠিন হয়ে যায়, সে সমাজে ব্যাভিচার সহজ হয় – আমাদের এ সমাজে গোপনে বিয়ে মন্দের ভালো, কিন্তু গ্রহনযোগ্য সমাধান নয়।

যারা গোপনে বিয়ে করেছেন / করতে যাচ্ছেন, তারা ভেবে দেখবেন।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *