যদি লড়াইয়ে হেরে যাই এবং লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর

যদি লড়াইয়ে হেরে যাই

কোন লড়াইয়ে যদি হেরে যান আপনি, কি করবেন?

রবার্ট ব্রুস হার স্বীকার করেন নি। বার বার লড়াইয়ে ফিরে এসেছেন। ষষ্ঠতম বারে তিনি আর হারেন নি, জিতেছেন এবং লড়াইয়ের সমাপ্তি নিশ্চিত করেছেন।দারাশিকোর পূর্বপুরুষ মোঘল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবরও হারতে রাজী ছিলেন না। তার জীবন কেটেছে লড়াইয়ের ময়দানে – হেরেছেন, ফিরে এসেছেন, জিতেছেন, আবার হেরেছেন, আবার ফিরেছেন, জিতেছেন – তার এই লড়াইয়ের আবর্তন শেষ পর্যন্ত তাকে বিজয়ী করেছে, মুঘল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে তিনি লড়াই থেকে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। কিন্তু তার বংশধর মুঘল সম্রাজ্যের সন্তান দারাশিকো লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর ফিরতে পারেন নি। প্রতিপক্ষের তুলনায় তিনি জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু যোগ্য ছিলেন না। লড়াইয়ে ফেরার স্বপ্ন নিয়ে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু লড়াইয়ে ফেরার আগেই তার মুন্ডু চলে গিয়েছিল প্রতিপক্ষের কাছে।

লড়াইয়ে হেরে গেলে সেই হার সহ্য করতে না পেরে দড়িতে ঝুলে পড়ে অনেকে। কেউ কেউ নিয়ম ভেঙ্গে প্রতিপক্ষকেই মেরে ফেলে – তাতে অবশ্য লড়াইয়ে জেতা হয় না, লড়াইয়ের মাত্রা পরিবর্তন হয় কেবল।

আমার যে লড়াই, তাতে হেরে গেলে আমি কি করবো?

প্রথমে পালিয়ে যাবো, তারপর হারিয়ে যাবো।

বর্তমানের ইন্টারকানেক্টেড এই দুনিয়ায় কিভাবে হারিয়ে যেতে হয় সেটা শেখা যাবে জ্যাক রিচারের কাছ থেকে – বই পড়ে অথবা সিনেমা দেখে। জ্যাক রিচার ইউএস এর বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে দেশ থেকে বের হন, তারপর অবৈধ পাসপোর্ট নিয়ে আবার দেশে প্রবেশ করেন। জ্যাক রিচারের কোন ইমেইল নেই, কোন ফেসবুক বা টুইটার আইডি নেই। জ্যাক রিচারের কোন মোবাইল ফোন নেই, ট্যাক্স আইডেন্টিফাইং নাম্বার নেই, ইউটিলিটি বিল রেজিস্ট্রেশন নেই। তার কোন গাড়ি নেই – সে হিচহাইকিং বা পাবলিক বাসে ভ্রমণ করে। তার সাথে থাকে টাকা পয়সা, ভাঁজ করা যায় এমন টুথব্রাশ, এটিএম ডেবিট কার্ড এবং একটি এক্সপায়ার্ড পাসপোর্ট। জ্যাক রিচারকে কেউ খুঁজে পায় না, বরং প্রয়োজন হলে জ্যাক রিচারই খুঁজে নেয়।

হারিয়ে যাওয়া খুব কঠিন কিছু না। দেশের মধ্যেই পালিয়ে যেতে হলে হিল ট্র্যাক্টস আদর্শ জায়গা। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘আকাশ বাড়িয়ে দাও‘ উপন্যাস পড়ে আমি প্রথম ধারনা পেয়েছিলাম পালিয়ে থাকার এই জায়গা সম্পর্কে। হিল ট্র্যাক্টস ঘুরে এসে নিশ্চিত হয়েছি। দেশের বাইরে? কানাডা, আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, শ্রীলংকা, নিদেনপক্ষে ভারতের কোলকাতা অথবা মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদ জেলায় অজন্তা গুহার আশে পাশে।

আমেরিকায় গ্রান্ড ক্যানিয়নে ঘুরে বেড়ানোর সময় আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদের ‘ওড়াউড়ির দিন‘কে মনে করব। শ্রীলংকায় যাবো জেফরি বাওয়ার আর্কিটেকচারাল কাজকর্ম দেখতে, এবং আর্কিওলজিক্যাল সাইটস। হুমায়ূন আহমেদের ‘রাবনের দেশে আমি ও আমরা‘ বইতে তার সাথে ছিল স্ত্রী শাওন – আমার সাথে কে থাকবে? কোলকাতায় বা মহারাষ্ট্রে ফেলুদা ছিল তোপসের সাথে, ফেলুদাকে বাদ দিয়ে অজন্তা গুহা, কিংবা কোলকাতার সেমিট্রি আমার ভালো লাগবে? বোধহয় এ কারণেই ফ্রান্সে আমার যাওয়া হবে না। কারণ সেখানে মিউজিয়াম আর ‘শ্যাতো’ দেখতে হলে আমার অবশ্যই চাই একজন মার্গারেট, সুনীলের যেমন ছিল ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইতে। মার্গারেট হবার প্রতিশ্রুতি দিলে আমি হেরে যাওয়ার পর ঠিক ফ্রান্সে চলে যেতাম, তারপর জ্যাক রিচারের মত পরিচয় গোপন করে মার্গারেটের সাথে ঘুরে বেড়াতাম – মিউজিয়ামে, আর শ্যাতো-সাইটগুলোতে।

হেরে যাওয়ার পর পালিয়ে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা সেটাও একটা লড়াই, সেই লড়াইয়েও যদি হেরে যাই, তখন কি হবে?

লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর

কোন লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর পালিয়ে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা সেটাও একটা লড়াই, সেই লড়াইয়েও যদি হেরে যেতে হয় তবে দ্বিতীয় আরেকটি উপায়ই থাকে – ‘প্রে ফর মি’ বলে জীবনবাজি রেখে পুনরায় লড়াইয়ে ফিরে আসা। 

জুন মাসে জন্ম বলে বাবা-মা উনার নাম রেখেছিলেন জুন। ২০১২ সালের জুন মাস আসার দুমাস আগে এপ্রিলেই লড়াইয়ে হেরে গিয়ে পালিয়ে গিয়ে হারিয়ে গেলেন জুনভাই। জ্যাক রিচার সম্পর্কে তার ধারনা ছিল না, এখনো নেই – কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার জন্য ইন্সটিংক্টই যথেষ্ট। জুনভাই প্রথমে চাকরী ছেড়ে দিলেন, তারপর হারিয়ে গেলেন। দুটো সেল নাম্বারের একটিও খোলা পাওয়া গেল না, পাঠানো মেসেজগুলো দুই দিন বাতাসে ঘোরাফেরা করে ফেরত আসতে লাগল। ফেসবুক আইডি ডিঅ্যাকটিভেট হয়ে গেল, টুইটারে অ্যাকাউন্ট ছিলই না, জিমেইলে মেইলের রিপ্লাই আসা বন্ধ হয়ে গেল। জুনভাইয়ের পরিচিত সব জায়গায় নক করেও ৩০শে এপ্রিলের পরের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। 

সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে একদিন সকাল নটায় আমি জুনভাইয়ের বাসা খুঁজে বের করে বন্ধ কলাপসিবল গেটের সামনে দাড়িয়ে থাকলাম। মিনিট বিশেক দাড়িয়ে থেকে ডাকাডাকি করেও দরজা খোলা গেল না, ফিরে আসবো এমন সময় বিল্ডিং এর অন্য কোন বাসিন্দার বদান্যতায় কলাপসিবল গেটের ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেয়ে গেলাম। কিন্তু জুন ভাইয়ের বাসায় কোন লোক ছিল না, দরজায় বড় বড় দুটো তালা। ভিজিটিং কার্ডের পেছনে ছোট্ট চিঠি লিখে তালার মাঝে গুজে রেখে ফেরত এলাম, কিন্তু কেউ যোগাযোগ করল না।

মাসখানেক পর এক ছুটির দিনে আবারও গেলাম। এবারও ডাকাডাকির কোন ফল পাওয়া গেল না, তবে কোন এক বাসার কাজের বুয়ার কারণে ঢুকে পড়তে পারলাম। দরজা খুলল জুনভাইয়ের রুমমেট জন। জুনভাই সংক্রান্ত কোন খবরই তার কাছ থেকে পাওয়া গেল না, তবে জুনভাইয়ের ছোট ভাইকে পাওয়া গেল জুনভাইয়ে বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থায়। আমার সকল ধরনের প্রশ্নের উত্তরে তিনি শুধু একটা কথাই বললেন – ভাইয়াকে বলবো আপনাকে ফোন করতে। জুনভাই আমাকে আর ফোন করেন নি।

২০১৩ সালের জুন পেরিয়ে অক্টোবরের এক সন্ধ্যায় নতুন এক নাম্বার থেকে ফোন এল – হ্যালো, আমি জুন! সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে হেরে গিয়েছেন জুনভাই। পুরাতন লড়াইয়ে ফিরে আসা ছাড়া তার কোন বিকল্প ছিল না – পুরানো প্রতিদ্বন্দ্বীরাও প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে – দেড় বছর বাদে জুনভাইকে ফিরতে দেখে জুনভাইয়ের সামনেই অন্যদের জানিয়ে দিয়েছে – জুন এসেছে অক্টোবরে, এবার ক্যু হবে!

লড়াইয়ে প্রত্যাবর্তনে স্বাগতম জুনভাই। ফাইট জুনভাই! ফাইট টু উইন!! বেস্ট অব লাক!!!

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *