কারওয়ানবাজারে বেড়ানো

কোন কোন দিন অফিস থেকে ফেরার সময় যদি মন ফুরফুরে থাকে সেদিন আমার ফনিক্স সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে টুপ করে কারওয়ানবাজারে ঢুকে পড়ি। 

কারওয়ানবাজার আমার কাছে এক বিশাল আশ্চর্যময় জগৎ। কত পদের পণ্য, মানুষ আর দোকান – অবাক লাগে। কারওয়ানবাজারকে আগে শুধু মাছ বাজার বলে জানতাম। বছর ছয়েক আগে থেকে কাঁচা ও পাকা বাজার হিসেবেও চিনলাম। প্রায় এক বছর এই বাজার থেকে কেনাকাটাও করা হয়েছে। যেদিন কারওয়ানবাজারে বেড়াতে যাই সেদিন বুঝতে পারি কারওয়ানবাজার শুধু মাছ -কাঁচা-পাকা বাজার নয়, কারওয়ানবাজার একটা ফলপট্টি, কারওয়ানবাজার একটা কাঠপট্টি, কারওয়ানবাজার একটা আসবাববাজার, একটা কাপড়ের বাজার, আরও নানাপদের বাজার। এর আগে যতবার বেড়াতে গিয়েছি তখন শেষ বিকেল ছিল, আজ বেড়ালাম রাতের কারওয়ানবাজারে।

তেজগাঁও রেলগেট পার হয়ে ডানদিকে ওয়েল্ডিং এর দোকানগুলো পার হয়ে বামদিকে মোড় নেয়ার বদলে সোজা ঢুকলেই ফলপট্টি শুরু হয়ে গেল। মৌসুমী ফলের দোকান সব, এখন বেশীরভাগই আম। নানা আকৃতির সবুজ রঙা আম। আছে লিচু। আর আছে তাল। তিনআটির একটা তাল দশটাকা। তাল বিক্রি করছিল যে লোকটা তার বাড়ি ফরিদপুর।

আম-তালের পরই সুপারির দোকানের সারি। সুপারিকে কি ফল বলা যাবে কিনা সেটা ভাবা শেষ হওয়ার আগেই চালের আড়ৎ শুরু। চালের বস্তার দেয়াল তুলে মাঝে ছোট একটি টেবিলের উপর ছোট ছোট আট-দশটি সিলভারের বাটি, সেখানে চালের স্যাম্পল। চালের বস্তায় রঙ্গীন অক্ষরে লেখা – হুক লাগাবেন না।

চালের পর শুটকির বাজার। কারওয়ানবাজার নাকি কুয়াকাটার শুটকি পল্লী? শুটকী কিন্তু বেশ দামী। শুটকির পরে ফার্নিচার বানানেওয়ালাদের দোকান। আর ডানদিকে কামারের তৈরী পণ্য। কোদাল। কুড়াল। হাতুরি। ছেনী। লোহার তৈরী জিনিসপত্রের দোকান শেষ হতেই কারওয়ানবাজার থেকে বাহির হওয়ার রাস্তা, কিন্তু আমি সাইকেল ঘুরিয়ে আবার ভেতরের দিকে ঢুকে পড়ি।

এই গলিতে কাপড়ের দোকান। একদিকে ছেলেদের, অন্যদিকে মেয়েদের। বাচ্চাদের পোশাক দুদিকেই। ডানদিকের তিনতলা মার্কেটের প্রায় পুরোটাই কাপড়ের দোকান। ডানদিকের বিল্ডিং এ পাকা বাজার। দুই বিল্ডিং এর মাঝে দাড়িয়ে একটা ছেলে কাচা আম মাখিয়ে বিক্রি করছে। সাইকেল ঘুরিয়ে বের হওয়ার রাস্তায় উঠলাম। এবার শুরু হল কাঠপট্টি। একটা গলিতে বিক্রি করে সস্তার চৌকি, চেয়ার, টেবিল।

সর্দারনী টাইপের কিছু মহিলা সবসময় দেখা যায়। আজ কাউকে পাওয়া গেল না। পাশের গার্মেন্টসটার ছুটি হয়েছে। ঝাকে ঝাকে গার্মেন্টস কন্যারা বের হচ্ছে। ফুরফুরে মন বলেই বোধহয় আজকে গার্মেন্টস কন্যারা চিন্তার ভেতর ঢুকে গেল। হাসতে হাসতে বের হয়ে আসছে মেয়েরা। এত হাসে কিভাবে এরা? দৈনিক কয়েক কিলো রাস্তা হেটে এরা অফিসে আছে, কয়েক ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে অফিস করে, তারপর আবার কয়েক কিলো হেটে ঘরে ফিরে। কয়েকমুঠো খেয়ে, কয়েকঘন্টা ঘুমিয়ে আবার কয়েক কিলো হেটে অফিস। আমার মনটা কেমন দুখু দুখু হয়ে গেল। দুঃখবিলাস।

কারওয়ানবাজার ভ্রমণ সব মিলিয়ে পনেরো মিনিটের, দুঃখবিলাস কয়েক মিনিটের। সাদা জামা পড়া একটা মেয়ের পিছু পিছু চলতে চলতে বাজার থেকে বের হয়ে এলাম। ভ্রমণ শেষ। প্যাডেলে চাপ বাড়ল।

কারওয়ানবাজারের এই যজ্ঞে আপনার আমন্ত্রন – যে কোন দিন, যে কোন সময়ে।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *