দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে

ভারতীয় সিনেমা আমদানীর মাধ্যমে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসের চক্রান্ত

ঠিক এই মুহুর্তে দেশের সবচে’ গুরুত্বপূর্ন ইস্যু বোধহয় তেল-গ্যাস রপ্তানি- কনকো ফিলিপস চুক্তির মাধ্যমে দেশের সম্পদ বিদেশে রপ্তানি করে দেয়ার মাধ্যমে কিছু কাঁচা টাকা এবং অবশ্যই ভবিষ্যত দেউলিয়াত্ব-অকল্যানের অর্জন। এই তেল-গ্যাস চুরি ঠেকাতে সচেতন যুবসমাজের এক অংশ নিজ দায়িত্বে উদ্যোগী হয়ে নিজ নিজ ক্ষমতাবলে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে, এবং ই-মিডিয়া বিশেষত: ব্লগ এবং ফেসবুক এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এই প্রতিবাদী শক্তি নিজেদের ‘টোকাই’ নামে ডাকছে।

আক্ষরিক অর্থে টোকাই এর মানে যাই হোক না কেন, প্রায়োগিক দিক থেকে এর গুরুত্ব অসীম। ‘স্বদেশী’ শব্দটি যেমন একদল মানুষকে ব্রিটিশ বিরোধী অন্দোলনে সংঘবদ্ধ করেছিল, টোকাই আন্দোলনও সেরকম ইতিহাস তৈরী করতে পারে। এই তেল-গ্যাস চুরি ঠেকানোর জন্য টোকাইরা যখন বাস্তব এবং ভার্চুয়াল ময়দানে ব্যস্ত তখন চুপিসারে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ডাকাতির পয়লা আঘাত হানা হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আবদুল জব্বার খান, খান আতা, ইআর খান, আলমগীর কবির, কাজী জহিরের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্প রক্ষার জন্য ১৯৭২ সালে বিদেশী সিনেমা আমদানি বন্ধ করেছিলেন। গতবছর ২৫শে এপ্রিল তারিখে বানিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব:)ফারুক খান ভারতীয় সিনেমা আমদানীর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার কথা জানান এবং বলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচানোর জন্যই ভারতীয় ছায়াছবি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বোধহয় বর্তমানে সবচে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দেশে ১৯৯০-৯১ সালে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১২৩০, ২০১০ সালে এই সংখ্যা নেমে এসে দাড়িয়েছে ৭৪২-এ। ঢাকার ৪৪টি সিনেমা হলের মধ্যে এখন আছে ৩৩টি, এগারোটিকে গুড়িয়ে দিয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল অট্টালিকা। গুলিস্তান, শ্যামলী, নাজ, লায়ন, স্টার, শাবিস্তান, তাজমহল সিনেমা হারিয়েছে অনেক আগেই

সিনেমা হল বন্ধের পেছনে মূল কারণ হলো নির্মিত সিনেমার অবস্থা। কাহিনী আর অভিনয়ের দুরাবস্থা নিয়েও বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বছরে ১০০টি সিনেমা মুক্তির ইতিহাসও আছে। গত এক দশকের তুলনায় ২০১০ সালে নির্মিত সিনেমার সংখ্যা সবচে কম, মাত্র ৬৩টি। ভয়াবহতার এই শেষ নয়, ২০১১ সালের প্রথম ছয় মাসে, জানুয়ারী থেকে জুন মাস পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে মাত্র ১৯টি সিনেমা, বিনিয়োগকৃত টাকার পরিমান মাত্র ৩০ কোটি টাকা।

বানিজ্যমন্ত্রীর ঘোষনার পরে সেই সময় সিনেমার প্রযোজক-পরিচালক সমিতি এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঘোষনা দেন, প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে আমদানি নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার অনুরোধ করেন। তাদের সাথে সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্ট লেখক-বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদে অংশগ্রহন করেন, অবশ্য এই প্রস্তাবের পক্ষে কথা বলেছেন এমন গুনী ব্যক্তিরাও রয়েছেন, যেমন লেখক-পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ।

সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্ট ২৫,০০০ লোকের কর্মসংস্থান বিলোপের আশংকা অবশ্য শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে, তিনি বানিজ্যমন্ত্রীকে তিরস্কার করেন এবং প্রস্তাব বাতিলের নির্দেশ দেন। হাইকোর্ট ও এই নির্দেশের সপক্ষে রায় প্রদান করেন। প্রদর্শকরা এই রায়ের বিপক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করেন এবং উচ্চ আদালত তার রায়ে ভারতীয় ছবি আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার আগে যে ছবিগুলোর জন্য এলসি করা হয়েছিল সেই তিনটি ছবিকে অনাপত্তিপত্র দেওয়ার নির্দেশ দেন। অনাপত্তিপত্র প্রাপ্ত তিনটি সিনেমা জোর, বদলা এবং সংগ্রাম ইতিমধ্যেই সেন্সরবোর্ডে জমা দেয়া হয়েছে, খুব শীঘ্রই মুক্তি পাবে সেগুলো।

জানা গেছে, থ্রি ইডিয়টস, মাই নেম ইজ খান, তারে জমিন পার, রং দে বাসন্তী, দাবাং, ম্যায় হুঁ না, কাভি আল বিদা না কেহনা, ওম শান্তি সহ মোট ৯টি সিনেমা এই তালিকায় আছে যা এ বছরেই অনাপত্তিপত্রের জন্য আবেদন করা হবে।

মাত্র একজন শাকিব খান নির্ভর সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বেশী দিন টিকে থাকবে না সেটা সত্যি এবং এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে – এতেও আপত্তি নেই – কিন্তু সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে দাড়ানোর সুযোগ করে দেয়াও চাই। গত এক দশকে কথিত কমার্শিয়াল সিনেমার বিপরীতে বেশ কিছু নবীন-সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা এগিয়ে এসেছেন, তাদের নির্মিত সিনেমাগুলো অখাদ্য ‘আর্ট ফিল্ম’ নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসাসফল। অত্যন্ত: ব্যয়বহুল সিনেমা নির্মানের পূর্বেই এর ব্যবসা নিশ্চয়তা পরিমাপ করা হয় এবং নি:সন্দেহে, ভারতীয় সিনেমার প্রবেশ এই নিশ্চয়তাকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ন করে তুলবে।

সাময়িক মুনাফার লোভে একটা সম্ভাবনাময় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংসের মুখে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। ভিনদেশি সিনেমা কিভাবে একটা দেশের ইন্ডাস্ট্রিকে খোড়া করে দেয় তার যোগ্য উদাহরণ ইন্দোনেশিয়া যেখানে ২০০২ সালে নির্মিত সিনেমার সংখ্যা মাত্র ১০ এবং এর পূর্বের দুই বছরে মাত্র ৬টি। বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি আমদানি নির্ভর হয়ে যাবে সেটা কখনোই কাম্য নয়।

অনাপত্তিপত্রের আড়ালে যে তিনটি সিনেমা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং আরও ৯টি প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তা যেন এখানেই শেষ হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ২৫০০০ সিনেমা শ্রমিকের নিরাপত্তাই শুধু নয়, দিনে দিনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা হয়েছে, তাকে অনুৎপাদনশীল অবস্থায় ফেলে রাখার সিদ্ধান্ত হবে হঠকারি। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে আরও উন্নত এবং মুনাফাসম্পন্ন করার জন্য উদ্যোগ আমাদেরকেই নিতে হবে, প্রয়োজনীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমাদেরই সৃষ্টি করতে হবে, কিন্তু সেজন্য ভারতীয় সিনেমা এখনই প্রয়োজন নয়।

রাজনৈতিক সম্পাদিত-প্রকাশিত

 

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

3 Comments on “দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে”

  1. dear Nazmul,

    Prothomoto,ami tomar sathe ekmot. FDC theke jei maner cinema gulo banano hoi, segulo je kotota nimno maner, seta amra sobai valo korei jani, tarporeo egulo bebsa kore jacche, karon jara esob dekhe, tara keu lalon er deshe jonmo nei nai je, jonmo matroi ek dhoroner ‘sense’ tairi hoe jabe. Ta sotteo, eta kokhonei kammo noi je, bairer cinema bd te prodorshon kore oder biruddhe protishodh ba protikar korar ei attoghati poth beche nite hobe. Somadhan ta korte hobe, nijeder vitor thekei, bairer lok ke kokhonei ondor mohole dhukte dite nai, Etihas bole, era eksomoy nijer ghor bole, ghorer asol malik ke ber kore dey. Sobcheye boro kotha, manuser jibika, jei desher manus kaj er ovabe ghure berai, sekhene nijeder jetuku ache, setukuo dhonsho korar bilashita, ekmatro bd er osovvo politician rai korte pare. Onnodike, india er cinema er man je khub valo, seta kintu na, oder technology world class, kintu oti nimno maner cinema orao banai ebong amader bd er lokjon shoho, nimno maner ugro, sense hin manush gulo egulo gile khai. Amader desher cinemai jemon, 10 joner sathe fight kore jite, oder nayok gulo-o 20 joner sathe fight kore jite jai. Indian cinema jodi, karo dekhar sokh thake, tahole 10 taka die ekta dvd vara koreito dekhte pare, keuto kauke atkacche na. Er cheye, daily ekta hollywood fighting movie r pornography movie dehlei Indian cinema dekha ushul hoe jabe. Poriseshe, bd er osovvo, nogra, kutta politician ra, jara sobsomoy bideshider pa dhore thake, nijeder pocket vari korar jonno, eke eke ei desher sobi bikri kore dibe r esob dekhe amra onekei hoito manosik vabe osustho hoe jabo. Joy hok amader.

Leave a Reply to kabir Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *